উৎসবের নিরিখে বাঙালির যেন অবসরের বড়ই অভাব। কালী পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো শেষে এবার কার্তিক পুজো। কোথাও তিনি ‘স্কন্দ’, কোথাও আবার তিনি ‘সুব্রহ্মণ্য’ নামে পরিচিত। তিনি স্বয়ং চিরকুমার কার্তিক ঠাকুর। বঙ্গে দুর্গাপুজো কালীপুজোকে নিয়ে মাতামাতি থাকলেও কার্তিক পুজো নিয়ে তেমন উল্লাস-উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায় না। তবে স্থান বিশেষে পার্থক্য অবশ্যই বিদ্যমান। যেমন মালদা জেলার ইংরেজবাজারের সাহা বাড়ির প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো কার্তিক পুজো। এখানে কার্তিক পুজোকে ঘিরে মালদা বাসীর আবেগ-উত্তেজনার বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই।
তখন বাংলার মসনদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তুঁত-রেশম শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে মালদার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে। এমন সময়ই বেনারস থেকে মালদায় পাড়ি দেন মনমোহন সাহার পূর্বপুরুষরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে। মনমোহন সাহা, যাঁর বাড়ির কার্তিক পুজোই ‘সাহা বাড়ির কার্তিক পুজো’ নামে পরিচিত। তবে এই পুজোয় কার্তিক ঠাকুরের সাথে হাজির থাকেন আরো ২৩ জন দেবদেবী। মূল কার্তিক ঠাকুরের বাঁদিকে থাকেন ভগবতী, অন্নপূর্ণা এবং সরস্বতী। আর ডানদিকে মহালক্ষ্মী, লক্ষ্মী ও সাবিত্রীর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের মাঝে বিরাজ করেন আরো ৭ দেবদেবী। ডানদিকে থেকে তাঁরা হলেন বশিষ্ঠ, গণেশ, জয়া, মা গঙ্গা, বিজয়া, শ্রীকৃষ্ণ এবং বাল্মিকী। তবে এক্ষেত্রে দেব-দেবীর মূর্তির পাশাপাশি লক্ষ্য করা যায় পরীর অবস্থানও। এঁরা বাদেও আরো নয় জন দেবদেবীও উপস্থিত থাকেন কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে। ওপরে বাঁদিক থেকে দেখা যায় লব, লক্ষ্মণ, রাম, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ভরত, শত্রুঘ্ন ও কুশের মূর্তি। এই সারির শুরু এবং শেষে একটি সিংহ ও একটি সিংহীর উপস্থিতি চোখে পড়ে। তবে এতো দেবদেবীর উপস্থিতির কারণটিও বেশ উল্লেখযোগ্য। সাহা পরিবারের সর্বজেষ্ঠ্য পুত্রের যখনই একজন পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করত তখনই একজন করে দেবতা যুক্ত করা হত মূল কার্তিক ঠাকুরের সাথে। তবে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে মা ষষ্ঠীকে কার্তিক ঠাকুরের পত্নী রূপে পদতলে স্থান দিলে বন্ধ হয় এই নিয়ম।
তবে এত দেবদেবীর মাঝে কার্তিক ঠাকুরের প্রতিমাটিই সবচেয়ে বড়ো। ২০ ফুট উচ্চতার ডাকের সাজে এখানে সুসজ্জিত থাকেন কার্তিকেয়। এই পুজোকে কেন্দ্র করে মেলাও বসে। তার বিস্তৃতি ইংরেজবাজারের পাকুড়তলা থেকে ৪২০ মোড় পর্যন্ত। পুজো শেষে প্রতিমা নিরঞ্জন, সেও এক দেখবার জিনিস। মেলায় দর্শনার্থীদের সমাগম দেখলেই বোঝা যায় এই পুজোকে ঘিরে এলাকাবাসীর উত্তেজনা। এই মেলায় বিক্রি হওয়া কাঠের আসবাবপত্রের কদর খদ্দেরের কাছে অনেক। সঙ্গে দোসর এখানকার ভ্যাটের খই। কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করে মানুষের এমন উল্লাস আর অন্যত্র প্রায় বিরল!
Discussion about this post