হিমাচল প্রদেশের কুল্লু ভ্যালির পার্বতী উপত্যকার গভীরে লুকিয়ে আছে এমন এক গ্রাম যার নাম উচ্চারণ করলেই ভেসে ওঠে রহস্য, কৌতূহল আর বিস্ময়। এটি হল মালানা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৬৫২ মিটার উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন গ্রামটি যেন সময়ের বাইরে টিকে থাকা এক আলাদা জগৎ। বহু শতাব্দী ধরে পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নিজেদের সংস্কৃতি, বিচারব্যবস্থা, নিয়ম-কানুন আর সামাজিক আচারকে অক্ষুণ্ণ রেখে আজও মালানা টিকে আছে তার স্বতন্ত্রতা নিয়ে। গ্রামের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে এক কঠোর চেকপোস্ট – কেন এসেছেন, কোথায় যাবেন, কতক্ষণ থাকবেন, সবকিছুর উত্তর মিলিয়ে নিতেই হবে। ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে এখানে এমন কড়া আইন যে ভুল করে কারও ঘরবাড়ি বা কোনও বস্তু স্পর্শ করলেও দিতে হয় ভারী জরিমানা। এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই যেন তৈরি হয়েছে এক শক্ত, সুসংগঠিত ও রহস্যঘেরা সমাজ – যার কারণে মালানাকে বলা হয় ‘হিমালয়ের এথেন্স’।

মালানার রহস্য শুধু কঠোর সামাজিক রীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়; তার গভীরতম বিস্ময় লুকিয়ে আছে কানাসি নামের স্বতন্ত্র ভাষায়। বিশ্বের আর কোথাও এই ভাষার চর্চা নেই। সুইডেনের আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, এই ভাষা চীন-তিব্বতি পরিবারভুক্ত হলেও ইন্দো-আর্য ভাষার কোনো ছোঁয়া নেই। ভাষাবিদদের বহু গবেষণার পরও কানাসির উৎস অজানাই থেকে গেছে। মালানাকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে আলোচিত একটি দাবি হল, তারা নাকি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্যদের বংশধর। প্রচলিত আছে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় আহত একদল সৈন্য এই উপত্যকায় আশ্রয় নেয়। তাঁদের শারীরিক গঠন, গায়ের রঙ বা কিছু অভ্যাসের সঙ্গে মালানার মানুষদের মিল খুঁজে নিয়ে আজও এই গল্পকে ঘিরে কৌতূহল তৈরি হয়। যদিও ইতিহাসবিদদের বড় অংশই এটিকে রোমাঞ্চকর উপকথা বলে মনে করেন। তবুও গ্রামের দ্বিকক্ষীয় আইনসভা – উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ গ্রিক ঐতিহ্যের সেই গল্পকেই রহস্যময়ভাবে জীবিত রাখে।

এই পাহাড়ি গ্রামকে ঘিরে আরেক সময়ের কুখ্যাতি ছিল বিশ্ববিখ্যাত ‘মালানা ক্রিম’ হাশিশ নিয়ে। হিমালয়ের বিশেষ আবহাওয়া ও মাটিতে জন্মানো উন্নতমানের গাঁজা থেকে তৈরি এই হাশিশ আন্তর্জাতিক মাদকজগতে এক কিংবদন্তির মতো সুনাম পেয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে মাদক ফর্মুলা চুরির চেষ্টায় পর্যটকের ছদ্মবেশ, রহস্যজনক মৃত্যুর খবর – সব মিলিয়ে মালানা যেন হয়ে ওঠে রোমাঞ্চ ও বিপদের এক অদ্ভুত অধ্যায়। তবে স্থানীয়রা এসব বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। আজকের দিনে গ্রামটি রয়েছে কঠোর সরকারি নজরদারিতে, আর পর্যটকদের ওপরও একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবুও এই রহস্যময়তা মালানাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। কঠোরতার মাঝে লুকিয়ে থাকা বহু বছরের গল্প যেন প্রতিটি পাথরেই চাপা পড়ে আছে।

আজ মালানা শুধু এক প্রাচীন বিচ্ছিন্ন গ্রাম নয়; বরং প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটক ও ট্রেকারদের কাছে এক অলৌকিক সৌন্দর্যের ভান্ডার। চারদিকে বরফে মোড়ানো শৃঙ্গ, দেব-টিব্বা ও চান্দেরখানি পাসের পথ, বয়ে চলা মালানা নদী – সব মিলিয়ে গ্রামটিকে ঘিরে আছে অপার্থিব শান্তি। গ্রামের প্রাচীন দু’টি মন্দির, কাঠখোদাই-নকশার ঘরবাড়ি, আর তুষারঢাকা পথে হাঁটার অভিজ্ঞতা এই দূরবর্তী স্থানে ভ্রমণকে পৌঁছে দেয় অন্য এক স্তরে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, মালানা কি সত্যিই বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক গ্রাম? এর নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। কিন্তু হয়তো তার প্রয়োজনও নেই। কারণ মালানার প্রকৃত বিস্ময় লুকিয়ে আছে তার সেই স্বতন্ত্র জীবনধারা, প্রাচীন বিচারব্যবস্থা, রহস্যময় ভাষা ও কঠোর নিয়মের সম্মিলনে গড়ে ওঠা এক অদ্ভুত, অনন্য সমাজে। যা হিমালয়ের কোলে আজও টিকে আছে নিজের মতো করে, সময়ের স্রোতকে অগ্রাহ্য করে।
চিত্র ঋণ – মহেশ ঠাকুর, কিরণ কাটোচ, সুনীল ঠাকুর






































Discussion about this post