আসামের তিনসুকিয়া জেলায় অবস্থিত ডিব্রু-সাইখোয়া ন্যাশানাল পার্কের মধ্যে অবস্থিত ‘মাগুরি বিল’। জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্বের জন্য সারা প্রায় পৃথিবী জুড়েই বিশেষভাবে খ্যাত এই স্বাদু জলের জলাভূমিটি। মাগুরি বিল বিভিন্ন প্রকার মাছের ব্রিডিং গ্রাউন্ডও বটে। প্রায় ৪৮টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া যায় এখানে। শীতকালে এখানে দেখা মেলে অজস্র পরিযায়ী পাখির। জলাভূমিটির চারপাশের অঞ্চলে বসবাস করেন বহু মানুষ। চাষ-বাসই মূলতঃ তাঁদের জীবিকা। সেই চাষের জন্যও জলের জোগান দিয়ে আসছে বিলটি। বিভিন্ন মানুষের রুজি-রোজগারের ভরসা এই মাগুরি বিলই ইদানীং অস্তিত্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে।
গত ২৭ মে এই অঞ্চলের ইন্ডিয়ান অয়েল লিমিটেডের বাগজান তৈল খনিতে বিস্ফোরণ ঘটায় পাইপ ফেটে শুরু হয় লিকেজ, যা গত ৯ দিন ধরেই হয়ে চলেছে। ক্ষতিকারক দূষিত তেল এবং গ্যাস জলে গিয়ে মিশছে চাষের জমিতে। বাতাসেও ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে গ্যাসের বিষাক্ত ধোঁয়া। ফলত চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র। বিলের ধারের তৃণভূমি থেকে শুরু করে প্রচুর গাছ আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে। ধ্বংস হচ্ছে চাষের ফসলও। বাদ যায়নি মাগুরি বিলের জলও। জলে ক্ষতিকারক তেল মিশে মৃত্যু ঘটেছে বহু প্রজাতির মাছের। যার মধ্যে অন্যতম হল বিলুপ্তপ্রায় সাউথ এশিয়ান রিভার ডলফিন। মারা যাচ্ছে প্রচুর পাখি এবং তাদের বাচ্চাও। এলাকায় বসবাসকারী প্রায় চার হাজার মানুষ আজ ঘরছাড়া। ক্ষতি হয়েছে চাষের জমির, তাই বন্ধ রোজগারের পথও। আপাততঃ তাঁদের ঠাঁই মিলেছে দূরবর্তী এক রিলিফ ক্যাম্পে। তবে শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা, অসুস্থতা ইত্যাদি নানা শারীরিক সমস্যার শিকার হয়েছেন তাঁরাও।
পরিবেশ আন্দোলন-কর্মী সৌরভ প্রকৃতিবাদীর বক্তব্য অনুযায়ী, এই ঘটনাকে কোনও সাধারণ পরিবেশ দূষণ বলা চলে না। বরং এটি রাষ্ট্র দ্বারা পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো পরিবেশ ধ্বংসের একটি রূপ। পরিবেশ দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী কোন সংরক্ষিত ‘ইকো-সেনসেটিভ’ অঞ্চলের অন্ততঃ দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও রকমের উন্নয়ন বা ইন্ড্রাস্টি গঠনের কাজ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কাজেই মাগুরি বিলের এত কাছে গড়ে ওঠা ইন্ডিয়ান অয়েলের তৈল খনিটিও সেই আইনের বিরূদ্ধেই স্থাপিত হয়েছিল বলে ধরা চলে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলছে ‘উন্নয়ন’-এর কাজ এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রই। শুধু তাই নয়! লকডাউনের মধ্যেই এই এলাকার আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায় খনন এবং পূর্ববর্তী তৈল খনি বর্ধিত করার অনুমতিও দিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দপ্তর। যা কখনই কাম্য নয়। এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসে সাধারণ কিছু মানুষই কিন্তু হাল ধরতে পারেন। তাই অবিলম্বে এই জলাভূমি ও বাস্তুতন্ত্র বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে আমাদেরই। তবেই হয়ত চারপাশের কনক্রিটের এই জঞ্জালের মধ্যেও একটুকরো সবুজ, আগামীর বার্তা দিয়ে যাবে আমাদের। জোগাবে বেঁচে অক্সিজেন।
চিত্র ঋণ – সত্যজিৎ দত্ত, তথ্য ঋণ – সায়ন রায়
Discussion about this post