ঝাড়গ্রাম-মেদিনীপুরের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম। সেখানে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাধ্যতামূলকভাবে চোখ গিয়ে পড়বে মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলোয়।কোথাও স্থির দৃষ্টিতে হরিণ তাকিয়ে থাকবে আপনার দিকে,কোথাও শুঁড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে মাতঙ্গ দল। মৎস্য থেকে ময়ূর, কাঁচা দেওয়ালে নিজের মতো রঙিন হয়ে বেঁচে আছে সব জীবই। মাটির দেওয়ালের আঁকা বাঘ হালুম করে এসে ঘাড়ে থাবা বসাতেও পারে!
তবে সে সব জীব কোনো শহুরে ম্যুরাল আর্ট নয়, এ হল ‘লাল মাটির দেশে’ আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব সোহরাই দেওয়াল চিত্র। নিছক কোনো সাধারণ দেওয়াল ছবি নয়,লোকশিল্প। এর নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে,অর্থ আছে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যযুক্ত, বৈচিত্র্যময় এক শিল্প। ফসল কাটার মরশুমে বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের বাড়ির দেওয়ালগুলো সাজিয়ে তোলে বিচিত্র উদ্ভিদ থেকে জীবজন্তুর রঙিন ছবিতে। এরই নাম সোহরাই। এই উৎসবের উপলক্ষ্য বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকৃতির কাছে তারা কৃতজ্ঞতা জানাতেই এই উৎসব আয়োজন করেন। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে যখন ঘরে তোলা হয় নতুন ফসল,তারা সাজিয়ে তোলে তাদের গৃহকোণ। পুজো করে গৌড়ীয় দেবতাকে। বিশেষ সেবা আত্তি চলে গবাদি পশুর। সর্বশক্তিমান প্রকৃতিই বেঁচে থাকার সমস্ত রসদের জোগান দাতা।এলাকার মানুষ তাই নিজেদের মতো করে ধন্যবাদ জানায় পৃথিবীকে।
সোহরাই শিল্প জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ পেয়েছে ২০২০ সালে। তবে ইতিহাস বলছে,এই চিত্র মূলত সেই সময়কার যখন মানব জাতি ছিল গুহাবাসী। গুহা ছেড়ে মানুষ নিজেদের গৃহে এলেও এই চিত্রকলা বজায়মান সশরীরে। এই চিত্রের রং তৈরি করা হয় নানা প্রাকৃতিক উপকরণ মিশিয়ে। তারপর তুলির টানে একে একে জীবন্ত হয় সব ছবি।
অনুশোচনার বিষয় একটিই। সময়ের তালে বাড়ির দেয়াল থেকে মুছে যাচ্ছে এই শিল্প। বর্তমান প্রজন্ম মুঠোফোনেই এখন বাইরের জগৎ চিনতে অভ্যস্ত।অথচ এই সোহরাই পূর্বসূরিদের জগৎ চিনিয়েছে সহস্র যুগ ধরে। তবে আশার আলোও আছে। কলেজ শিক্ষিকা মধুশ্রী হাতিয়ালের শক্ত হাতে এখনো বাঁচার আশা দেখছে সোহরাই। তাদের সংগঠন ‘মরমিয়া’ মানুষের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টিতে যথেষ্টই সফল। তিনি ডেইলি নিউজ রিলকে জানান,প্রাথমিক বাঁধা যদিও বা এসেছিল তবে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। তাঁদের উদ্যোগকে কৌতুহলী চোখে স্বাগত জানিয়েছেন এলাকার লোকেরা। মরমিয়া দল নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের উদ্যোগে বিলি করেছে নীতিকথার বই থেকে রামায়ণ মহাভারত। কারণ নিজেদের ইতিহাস না জানলে নিজেকে চেনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
মোবাইল পর্দা থেকে ছোটরা যাতে চোখ সরিয়ে বাইরের জগৎ দেখতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই তাঁরা এগোচ্ছেন ধীরে ধীরে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মধুশ্রী দেবী একাধারে ঝুমুর শিল্পী, ফলে এলাকার মানুষজনদের সাথে মিশে যেতে তাঁর খুব বেশি সময় প্রয়োজন হয়নি। তুলি হাতে তিনিও ছুটছেন ঝাড়গ্রাম-মেদিনীপুরের অঞ্চলে। এবং এই শিল্পের প্রচার করছেন পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও। শুধু মাটির বাড়িতেই নয়, সোহরাই স্থান পেতে পারে ইট সিমেন্টের দেওয়ালেও। মানুষ চাইলেই তা সম্ভব। এমন লোকশিল্পকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন মধুশ্রী হাতিয়ালের মতো মানুষজনই। এমন ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব লোকশিল্পকে পথ দেখানোর কান্ডারী তো তাঁরাই!
Discussion about this post