‘মান্ধাতার আমল’, একটি বহুল প্রচলিত কথা। প্রতিদিনের জীবনে আমরা কতবারই না ব্যাবহার করে থাকি। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা যে কে এই মান্ধাতা? কী তার পরিচয়? কেন তার সময়কাল এতটা বিখ্যাত? কী এমন ঘটেছিল তার সময়কালে? আজ সেই মান্ধাতার কথাই আলোচনা। পৌরাণিক ইতিহাস ঘাঁটলে তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়। আর বোঝাও যায় যে তাঁর সময়কালে কি ঘটেছিলো যে তিনি আজও এতটাই খ্যাতি সম্পন্ন। আসুন আজ সেই ইতিহাসের হলদে পাতায় একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। আর জেনে নিই সেই ‘মান্ধাতার আমল’ কে!
পৌরাণিক কাহিনী ও ইতিহাস অনুযায়ী মান্ধাতা ছিলেন সূর্য বংশের রাজা যুবনাশ্বের পুত্র। সেই সূর্য বংশ যে বংশে পুরুষোত্তম শ্রী রাম রাজা ছিলেন। এত গেল মান্ধাতার পরিচয়। কিন্তু আসল বিষয় হলো তাঁর জন্মের কাহিনী। তাঁর জন্মের ইতিহাসটা বেশ অবাক করার মতো। রাজা যুবনাশ্ব নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি পুত্র সন্তান লাভের আশায় মুনি ঋষিদের আশ্রমে গিয়ে যোগ সাধনা শুরু করেন। দিনের পর দিন নিষ্ঠা ভোরে যোগ সাধনা আর মুনি ঋষিদের সেবা করতে থাকেন তিনি। তাঁর সেবায় যারপরনাই সন্তুষ্ট হন মুনি ঋষিরা। তাই যুবনাশ্বের পুত্র লাভের জন্য তাঁরা এক মহা যজ্ঞ শুরু করেন। ভোর থেকে শুরু হওয়া সেই যজ্ঞ শেষ হয় প্রায় মধ্যরাতে। ফলস্বরূপ এক মন্ত্রপূত জল ভর্তি কলসি পান মুনিরা। এই জল যদি রাজার স্ত্রী পান করেন তাহলে পুত্রলাভ অবশ্যই হবে। এই সব আলোচনা করে মুনিরা সেই কলস এক বেদিতে রেখে বিশ্রাম নিতে চলে যান। কিন্তু এই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে রাজা বিন্দুমাত্র অবগত ছিলেন না। রাত্রে খুব তেষ্টা পেতে রাজা সেই কলসি থেকেই জল পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন। সকালে মুনিরা কলসের জল কম দেখে খানিক হতচকিত হয়ে পড়েন আর রাজা কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে তিনি গত রাতে তাঁর তৃষ্ণার কথা সমস্ত খুলে বলেন। সবটা শুনে মুনিরা বলেন যে যজ্ঞের ফল কখনো মিথ্যা হয়না তাই রাজার গর্ভেই জন্ম নেবে পুত্র সন্তান।
তবে যেহেতু রাজা অজান্তে এ কাজ করে ফেলেছেন তাই গর্ভধারণের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে মুনিরা এক উপায় নির্বাচন করলেন। আর তারই ফল স্বরূপ একশো বছর পূর্ণ হতে রাজার পেটের বামদিকে বিদীর্ণ করে জন্ম নেয় মান্ধাতা। এই ভাবেই মান্ধাতার জন্মহয়।কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যেহেতু মান্ধাতার কোনো মাতৃগর্ভে জন্ম হয়নি তাই তাকে দুধ কে খাওয়াবে? কে তাকে লালন পালন করবে? এই জটিল সমস্যার সমাধানে দেবরাজ ইন্দ্র এগিয়ে আসেন আর তিনি নিজে মান্ধাতাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নেন। শিশুর মুখে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর অমৃতক্ষরা তর্জনী পুরে দিয়ে বলেন ‘মাম ধাস্যতি’ অর্থাৎ ‘ আমাকে পান করো’। সেই থেকেই পুত্রটির নাম হয় মাম-ধাতা বা মান্ধাতা। ক্রমশঃ পড়াশুনা ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে সে। পরবর্তীকালে মান্ধাতা বিশ্ব জয়ে বেড়ান। যুদ্ধ করতে করতে তিনি প্রায় সারা পৃথিবীই জয় করে নেন। কেবল জিততে পারবেন না রাবনের কাছে। ভীষণ যুদ্ধ হয় রাবন ও মান্ধাতার মধ্যে সুমেরু পর্বতের উপর। বহুসময় ধরে সেই যুদ্ধ চললেও ফলাফল কিছুই আসছিল না। শেষে তাঁরা যুদ্ধ থামিয়ে সন্ধি স্থাপন করেন।
এরপর মান্ধাতা পাতাল ছেড়ে স্বর্গরাজ্য জয়ে উদ্ধত হন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে থামান। বলেন যে পুরো পৃথিবী এখনো জয় সম্পূর্ণ হয়নি। লবনাসুর এখনো তাঁর অধীনতা স্বীকার করেনি। এই লবনাসুর ছিল ব্রাহ্মণ ভক্ত রাজা মধূর পুত্র। এই মধূর উপর সন্তুষ্ট হয়ে দেবাধিদেব মহাদেব তাঁর ত্রিশূলের একটি শূল দিয়েছিলেন। এই শূল শত্রু বিনাশ করে আবার মধূর কাছে ফিরে আসতো। মধূর কাছে থেকে এই শূল পায় তার পুত্র লবনাসুর। দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে থেকে এই পরামর্শ পেয়ে মান্ধাতা আর রাবন আক্রমণ করে মধূ আর তার পুত্র লবনাসুর কে। ভীষণ লড়াই হয় তাদের মধ্যে। শেষে রাবন বিজয় পান রাজা মধূর উপর কিন্তু মান্ধাতা লবনাসুর এর কাছে পরাজিত হন ও মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে মান্ধাতার বংশধর শত্রুঘ্ন লবনাসুর কে পরাজিত ও নিহত করে। এই মান্ধাতা ছিলেন সত্য যুগের রাজা। দৈবযুগের চারটি ভাগের প্রথম ভাগ হলো সত্যযুগ। তার পরে আসে ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ, আর এখন কলি যুগ। তাই মান্ধাতার সময়কাল যে বহু প্রাচীন সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এই কারণেই বহুকাল আগের কথা বলতেই আমরা ‘মান্ধাতার আমল ‘ এই কথার প্রয়োগ করে থাকি। মান্ধাতা বহুকাল শাসন করেছিলেন আর সারা পৃথিবীতে জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস জানে শুধুই তার নাম আর শাসনামল। ঠিক কবে থেকে তাঁর শাসন কাল শুরু সেটা আজও ইতিহাসে অজানা এক রহস্য হয়ে থেকে গেছে।
Discussion about this post