কর্মসূত্রে দুই বন্ধু পাড়ি দিয়েছিল আন্দামানে। কাজ চলছিল পুরোদমে, তথ্যচিত্রের কাজ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলছিল গল্প, আড্ডা, খুনসুটিও। সাথে গরম গরম মাছ ভাজা আর মন মাতানো সামুদ্রিক হাওয়া। যেন এক স্বপ্নরাজ্য। কাজের ফাঁকে এমনই এক সন্ধ্যায় আন্দামানের সব থেকে সুন্দর বিচ ‘কর্বিনস কোভ বিচ’, এর বাঁকা পার ধরে দুই বন্ধু সান্ধ্য ভ্রমণে মিলিয়েছিল পা। চাঁদের আলোয় সমুদ্রের জলরাশি যেন হয়ে উঠেছিল রূপোলি তরল। সশব্দে ছোট ছোট ঢেউ এসে পাড়ে ভাঙছিল। বন্ধুত্বের পালেও লেগেছিল দামাল হাওয়া। ব্যাস সেই থেকে পথ চলা শুরু। কী ভাবছেন কোনও প্রেমের উপন্যাস বা ছোট গল্প লিখতে বসেছি? আজ্ঞে না, আজও কিছু ভালোবাসা সময়ের দলিলে জীবন্ত জীবাশ্ম হয়ে বেঁচে থাকে। ভালোবাসার প্রতিস্পর্ধাই তাদের পথ চলার পাথেয়। হ্যাঁ গল্পটা আসলে সুতপা ঘোষ ও তাপস বাপি দাসের প্রেম-বন্ধুত্ব নিয়েই।
“যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে, তোমারও লাগিয়া তখনই বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলি।” মনে কলি ধরেছিল কিনা জানা নেই, তবে একদিকে মঞ্চে বাপিসহ ঘোড়াদের দলবল, অন্যদিকে চোখে বিস্ময় নিয়ে দর্শকাশনে সুতপা! আলাপচারিতার সূত্রপাত কিছুটা এভাবেই। তারপর মুখোমুখি কথা বলার মুহূর্তগুলো প্রথম প্রাণ পায় বইমেলা প্রাঙ্গণে! তারপর পছন্দের তালিকায় একই রকম সাহিত্য, একই রকম গান, একই রকম ইচ্ছে, ভালোলাগাগুলো একে একে একাকার হয়ে যায়। বন্ধুত্ব হয় আরও নিবিড়, বিশ্বাসের ভিত পায় দৃঢ়তা। সম্পর্কে স্বচ্ছতা আর ভরসাকে সঙ্গী করে তাই তো রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটিকে ফুৎকারে উড়িয়েছিলেন তাঁরা। নিতে পেরেছিলেন লিভ-ইনের মতো সাহসী সিদ্ধান্ত।
সুতপা ঘোষ এক স্বাধীন তথ্যচিত্র পরিচালক। তার ঝুলিতে জমেছে নানান ছোট বড় পুরস্কারও। তারপরও ‘তাপস বাপির স্ত্রী’ মিডিয়া কিংবা ডিজিট্যাল মাধ্যমের সেঁটে দেওয়া এই ট্যাগ নিয়ে তিনি আলাদা করে কোনো আক্ষেপ করেননি। বরং তার ভালো লাগা, খারাপ লাগাগুলো স্পষ্ট করে বলেছেন। “তাপস বাপির স্ত্রী, এই ট্যাগের চাপে কোথাও গিয়ে যেন আমার আইডেন্টিটিটা হারিয়ে গিয়েছে। তাপস বাপির স্ত্রী হওয়া আমার কাছে যতটা গর্বের, নিজের আইডেন্টিটি হারিয়ে যাওয়া ঠিক ততটাই খারাপ লাগার। আরো বলি, বাপি কিন্তু এই মিডিয়া ট্যাগিয়ে দেওয়া ‘তাপস বাপির স্ত্রী’ কথাটা পছন্দ করতো না। ও নিজে কিন্তু আমার স্বাধীন কাজকর্মকে সাপোর্ট করতো। তারপরও জানিনা কিভাবে আমার আইডেন্টিটি হারিয়ে গেল।”
দীর্ঘ পঁচিশ বছরের স্মৃতির পাতায় ধুলো জমেনি এতটুকুও, আজও সবটা প্রথম দিনের মতোই তরতাজা। আজও ছোট ছোট স্মৃতি এসে ভিড় জমায় সুতপার মণিকোঠায়। কখনও আন্দামানের সবচেয়ে সুন্দর বিচের বাঁকা পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া, কখনও তাপস বাপি ভালোবেসে গান লিখে দিয়েছেন সুতপার জন্মদিনে, কখনও বা সুতপাকে কচুরিপানার ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাপস বাপি। বলাই বাহুল্য, দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সংসারে দু’জনে নিজেদের কাজের জগৎ সামলেও ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োজনীয় সময়টুকু ঠিকই দিতে পেরেছিলেন। কর্মসূত্রে দু’জনকেই বাইরে বেরোতে হতো, তাই দরজার বাইরে ঝুলত ছোট ছোট চিরকুট, পেন আর চাবি। চিরকুটে লেখা থাকতো একে অপরের জন্য খুচরো বার্তা। সম্পর্কে এতটাই স্বচ্ছতা, বিশ্বাস আর বন্ধুত্ব ছিল যে সুতপাকে আর আলাদা করে বলতে হয়নি “ইউ আর সো হ্যান্ডসাম, আই লাভ ইউ বাপি…” যদিও আজ সেই কথাই ডেইলি নিউজ রিলের মাধ্যমে তাপস বাপির উদ্দেশ্যে বলেছেন তিনি। আজ হয় তো মুখোমুখি তাপস বাপি থাকলে সুতপার উদ্দেশ্যে বলতেন ‘হায় ভালোবাসি’।
	    	
                                





























		    








Discussion about this post