মে দিবস অবদমিত-শোষিত শ্রমিক শ্রেণীর ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। নিজেদের কথা স্পষ্টভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতায় আসীন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ইতিহাস। এই দিনটিতে কেমন আছেন খাস কলকাতার বুকে অবস্থিত যাদবপুর কফিহাউসের কর্মচারীরা? ‘কফিহাউসের আড্ডা’র নস্টালজিয়ায় ভেসে যেতে ভালোবাসেন বাঙালি। কফি হাউসের মূল শাখা কলেজ স্ট্রীটের থেকে পরিসরে ছোট হলেও আজও আড্ডা, তর্ক, রাজনীতি, ইনফিউশন, পরনিন্দা-পরচর্চায় জমজমাট যাদবপুর হাউস। তবে কর্মচারীরা অর্থাৎ, খেটে খাওয়া মানুষগুলি কেমন অবস্থায় আছেন? এই ঐতিহাসিক দিনটি নিয়ে কতটুকু সচেতন এই তাঁরা?
কফি হাউসে ম্যানেজার অমিত বাবু জানালেন জমাটি আড্ডার ধোঁয়া আজও আছে বটে। যদিও কফি হাউসের ঐতিহ্য বদলে বদলে গিয়েছে বারবার। একবিংশ শতকের সময় থেকে কলকাতার অলিতে-গলিতে গজিয়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ আর ক্যাফে কালচার। একই সঙ্গে বদলেছে আড্ডার চরিত্র, সাধারণ মানুষের সঙ্গে খেটে খাওয়া মানুষের সম্পর্কের চরিত্র। আড্ডার সংস্কৃতির বদল আর পুঁজিবাদের চোখরাঙানির সঙ্গে সঙ্গেই অবধারিতভাবে মার খেয়েছে কফি হাউসের ব্যবসা। বিগত বছরগুলিতে কফি হাউসের ব্যবসায়িক ক্ষতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে করোনাকালীন লকডাউন। অনিবার্যভাবেই অবস্থার অবনতি ঘটেছে কর্মচারীদেরও।
বর্তমানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে যাদবপুর কফি হাউসের মোট কর্মচারী সংখ্যা আটজন। এঁদের মধ্যে তিনজন অস্থায়ী কর্মচারী এবং এঁরাই মূলত সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত কাজ করেন। মাঝে মাঝেই এই কর্মচারীদের চাকরি চলে যায়, আবার কিছু মাস পর তাঁরা ফিরে আসেন। অথবা অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নতুন কোনো মুখ দেখা যায়। এই বিষয়ে যাদবপুর কফি হাউস কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করলে তাঁরা জানান, “মূল কফি হাউসে অর্থাৎ কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় সেখানেই আমাদের বেশি কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। যাদবপুর কফি হাউসে তাই পার্ট টাইম কর্মীদের দিয়েই কাজ চালাতে হয়।” কর্তৃপক্ষ আরো জানান, “কর্মচারীরা ভালো আছেন, করোনার পর অবস্থা একটু খারাপ হলেও ভবিষ্যতে কর্মচারীদের অবস্থার আরো উন্নতি হবে আশা করা যায়।”
এমনই একজন অস্থায়ী কর্মচারী রশিদ। স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা কে নিয়ে তাঁর পরিবারে উপার্জনকারী তিনি একাই। অস্থায়ী, অনিশ্চিত এই কাজে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন না। কাজ স্থায়ী হওয়ার অপেক্ষা করছেন প্রায় দুই বছর। হঠাৎ চাকরি চলে গেলে সংসার কীভাবে চলবে এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “হয়তো বাকি আত্মীয়স্বজনের কাছে সাহায্য চাইতে হবে।” অন্ধকার ভবিষ্যতের সামনে কপালে ভাঁজ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন রশিদের মতোই আরো বেশকিছু অস্থায়ী কর্মচারী। স্থায়ী কর্মচারীদের অবস্থাও বিশেষ আশাপ্রদ নয়। কফি হাউসের বহু বছরের পুরনো কর্মচারী সুকুমার বাবুর বয়স ষাট পেরিয়েছে সদ্য। সংসার চালান তিনি একাই। বাড়িতে আছেন স্ত্রী, অসুস্থ সন্তান। সারাদিন কাজ করে রাত্রিটুকু কাটান কফি হাউসেই, মাসে দুই-একবার বাড়ি যান। আর্থিক, শারীরিক-মানসিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করলে তাঁর গলাতেও ঝরে পড়ে পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা।
সমস্ত অনিশ্চয়তার মধ্যেও অবশ্য টিকে আছেন যাদবপুর কফি হাউসের নিয়মিত আড্ডাধারীর বিভিন্ন দল। এই নিয়মিত খদ্দেরদের সঙ্গে কর্মচারীদের সম্পর্ক আন্তরিক। পুরনো কলকাতার সেই কফি হাউসের ঐতিহ্যকে যেন টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরাই। বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে কবি, সাহিত্যিক, লিটিল ম্যাগাজিন কর্মী, গবেষক, রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী সকলেই আছেন এই নিয়মিত আড্ডার মধ্যে। ধর্মনির্বিশেষে প্রতিটি উৎসবের সময়, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত দুর্ঘটনায় বা আপৎকালীন সময়, বিগত করোনাকালীন সময়েও এই নিয়মিত খদ্দেররা কফি হাউসের কর্মচারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বারংবার। অস্থায়ী কর্মচারীদের চাকরি চলে গেলে নিজেদের উদ্যোগে টাকা জোগাড় করে নতুন কর্মসংস্থানেও সাহায্য করেছেন এই আড্ডাধারীর দল।
তবে সব শেষে একটি বিষয় স্পষ্ট। আলাদা করে ঐতিহাসিক মে দিবসের তাৎপর্য বোঝার সময়, সুযোগ বা অবসর কোনটাই এই কর্মচারী তথা শ্রমিকদের নেই। কারো বাড়িতে অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার চিন্তা, কারোর মাথায় গোটা পরিবারের দায়িত্ব, কেউ নিজে অসুস্থ। সকাল এগারোটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত কাজ করে মাসের শেষে মাইনেটুকুই তাঁদের একমাত্র সম্বল। তাই যাদবপুর কফি হাউসের রশিদ, সুকুমার, অরুণ বা নূরদের ছুঁতে পারছে না আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের উত্তেজনার পারদ। সমাজের হাজার হাজার খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি হয়ে মাথা গুঁজে কাজ করে চলেছেন তাঁরা প্রতিদিন।
Discussion about this post