“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি?” সত্যিই ইতিহাসের পাতার এই রক্তে রাঙানো এই দিনটির কথা বাঙালি ভুলতে পারে না। আমাদের মাতৃভাষা আমাদের শিকড়ের পরিচয় দেয়। আর এই ভাষার জন্যই শহীদ হয়েছেন কত মানুষ। তবে শুধু বাংলাই নয়, নিজ মাতৃভাষার সন্মানের স্বীকৃতির জন্য লড়াই চলেছে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেও। এই আন্দোলনে রক্ত ঝরেছে বহু ভাষাশহীদের। তাঁদেরই এক বীরাঙ্গনা ভাষা শহীদ হলেন সুদেষ্ণা সিংহ।
বাংলা ভাষার মতোই মাতৃভাষার স্বীকৃতির জন্য এক দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন চলেছিল স্বাধীন ভারতের অসম ও মণিপুরে। অসমের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা অনেকেই অবগত হলেও, হয় তো খুব একটা নজরে আসেনি মণিপুরীদের ভাষা বিপ্লবের কথা। স্বাধীনতার পর সংবিধান নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের মৌলিক অধিকার দিলেও মণিপুরীরা বঞ্চিত ছিল এই অধিকার থেকে৷ ফলতঃ তাঁদের মধ্য জন্ম নেয় ক্ষোভ, শুরু হয় আন্দোলন। এই আন্দোলন চলেছিল সুদীর্ঘ সময় ধরে। মাতৃভাষা ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’-কে সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও শিক্ষার মাধ্যমে আনার দাবিতে নিজের বীরত্বের প্রদর্শন করেছিলেন ভাষা বিপ্লবী সুদেষ্ণা সিংহ। স্বাধীন ভারতে এটিই প্রথম আদিবাসী ভাষা বিপ্লব। আর ইতিহাসের পাতায় সুদেষ্ণা সিংহই হলেন প্রথম মহিলা আদিবাসী ভাষা শহীদ।
১৯৬৪ সালে সুদেষ্ণা সিংহ আসামের কচুবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামবাসীরা আদর করে তাঁকে ‘বুলু’ নামে ডাকতেন। শোনা যায় দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুদেষ্ণা। জীবনের বত্রিশটা বছর কাটিয়ে ১৯৯৬ সালে অসমের ‘ইমার ঠার’ আন্দোলনে যোগদান করেন। ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভাষায় ‘ইমার ঠার’ কথার অর্থ ‘মায়ের ভাষা’। নিজ ভাষা স্বীকৃতির জন্য ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চে ৫০১ ঘণ্টার রেল অবরোধের ডাক দেয় আন্দোলনকারীরা। সুদেষ্ণাও এই কর্মসূচিতে যোগ দেন। আন্দোলন চলাকালীন অবস্থায় সতর্কীকরণ ছাড়াই পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে বহু বিপ্লবী আহত হন। আর এই গুলির আঘাতেই শহীদ হয়ে চিরবিদায় নিলেন এই বীরাঙ্গনা নারী সুদেষ্ণা সিংহ।
সুদেষ্ণা সিংহের এই আত্মবলিদান তাঁর মাতৃভাষাকে এক নতুন জীবন দিয়ে গেছে। পরবর্তীকালে এই ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ কিন্তু রক্তে রাঙা ১৬ মার্চকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার নয় কখনোই। প্রথমে আসাম এবং পরে ত্রিপুরা সরকার থেকেও এই দিনটিকে ‘ভাষা দিবস’ হিসাবে সন্মান দেওয়া হয়৷ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেরও কিছু স্থানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাভাষীরা ১৬ মার্চকে ‘শহীদ সুদেষ্ণা দিবস’ হিসাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। ১,৬৫২ টি ভাষার দেশ ভারতে প্রত্যেক অঞ্চলেই রয়েছে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির এক মাটির গন্ধ। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, আমাদের ভাবাবেগ কিন্তু নিজ মাতৃভাষাতেই প্রকাশ পায়। আজ ভাষা দিবসে সেই সকল ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর দিন, যাঁরা নিজের জীবন দিয়েও লড়ে গিয়েছেন মাতৃভাষার জন্য। আজ তাই শুধু বাংলাকেই না ভারত তথা পৃথিবী জুড়ে সকল ভাষাকেই সন্মান জানানোর দিন। আজ সুদেষ্ণা সিংহদের মতো বীরাঙ্গনাদের মনে করার দিন।
চিত্র ঋণ – roar media
Discussion about this post