ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত বর্ধমানের প্রাচীনতম শহর কালনা। এখানে রয়েছে জাগ্রত মা অম্বিকা দেবীর মন্দির। দেবীর নামেই কালনার নামকরণ হয়েছে ‘অম্বিকা কালনা’। বর্গী হামলার সময় মারাঠারা যখন বর্ধমান আক্রমণ করেন। তখন সেখানকার জমিদাররা চলে আসেন কালনাতে। এখানেই তারা নতুন করে প্রাসাদ ও বিভিন্ন মন্দির নির্মাণ করেন। এই কারণে কালনাতে ছড়িয়ে রয়েছে বর্ধমান রাজাদের বহু প্রাচীন স্থাপত্যে। তবে কালনার নাম উল্লেখ করলে প্রথমেই মনে আসে প্রাচীন ১০৮ শিবমন্দির ও বর্ধমান রাজবংশের রাজবাড়ি। রাজবাড়ির অন্দরে রয়েছে প্রতাপেশ্বর মন্দির, রাসমঞ্চ, পঞ্চরত্ন মন্দির, বৈদ্যনাথ মন্দির, কৃষ্ণ চন্দ্রজি মন্দির ও লালজী মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে পুরনো দিনের বহু ইতিহাস।
লালজী মন্দির কালনায় বর্ধমান রাজাদের তৈরি মন্দিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সময়কাল সম্পর্কে জানা যায়, তার গায়ে থাকা শিলালিপি থেকে – “যৎ-পুত্রাঃ পৃথিবীতলে সুবিদিতাঃ সৎ কৃষ্ণচন্দ্রঃ কৃতী সা শ্রীরাজকুমারিকাঃ ব্রজকিশোরী কৃষ্ণভক্তয়র্থিনী শাকে বৈকষড়র্ক্তচন্দ্র গনিতে প্রাসাদমেতম্ দদৌ রাধাকৃষ্ণ যুগায় সৎ-কবিসভামধ্যেসু তৎ প্রিতয়ে। শকাব্দঃ ১৬৬১, যার মানে ১৬৬১ শকাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মন্দির।
মন্দির তৈরীর পেছনে রয়েছে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। প্রাচীনকালে সন্ন্যাসীরা পুণ্য অর্জনের জন্য কালনার ওপর দিয়ে নদীপথে পাড়ি দিত গঙ্গাসাগরে। তখন যাওয়ার পথে কিছু সন্ন্যাসীর দল কালনার এই গঙ্গার ঘাটে আস্তানা গড়ে। একদিন গঙ্গাস্নানে যাওয়ার পথে রাজমাতা ব্রজকিশােরী দেবী এমনি এক তাবু থেকে হঠাৎ এক বালকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কৌতূহল বশত তাঁবুতে প্রবেশ করলে তিনি এক সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন। বালকের প্রসঙ্গ সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করায়, তিনি জানালেন তার সঙ্গে রয়েছে শুধুমাত্র তার উপাস্য দেবতা কানাইয়ের মূর্তি। এই শুনে ব্রজকিশােরী দেবী সেই মূর্তি নিতে চাইলেন। কিন্তু রাজমাতার অনরােধেও মূর্তি দিতে চাইলেন না সেই সন্নাসী। তখন রাজমাতা জানালেন তার মেয়ের সাথে কানাইয়ের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। সন্ন্যাসী এ কথায় রাজি হলে ব্রজকিশােরী দেবী মাইজী’র বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা রাধারাণীর সঙ্গে বিয়ে দিলেন লালাজীর কানাইয়ের। এরপর ব্রজকিশােরী দেবী বহু অর্থ ব্যায় করে বিগ্রহদুটিকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং গড়ে তােলেন লালজী মন্দির।
পঁচিশরত্ন বিশিষ্ট এই মন্দির দক্ষিণমুখী। এই লালজী মন্দিরের সঙ্গে রাজবাড়ী চত্বরের কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরও গােপালবাড়ির গােপালজীর মন্দিরের হুবহু মিল পাওয়া যায়। প্রায় ১৫ ফুট প্রাচীর দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গনটি ঘেরা। প্রাঙ্গনের মূল প্রবেশদ্বার পেরলেই লক্ষ্য করা যায় মন্দিরের দ্বিতীয় তােরণের উপরে রয়েছে তিনটি ঘােড়ার (প্রকৃতি)। যা বর্ধমান রাজাদের ব্যবসায়িক দিকের প্রতিফলন। লালজী মন্দিরের মূল অংশটি একটি উঁচু বেদীর ওপর অবস্থিত। মন্দিরের মােট ২৫ টি চূড়া বা রত্ন যা ৪টি ধাপে বিভক্ত হয়েছে। মন্দিরের প্রথম তলার ছাদের চারকোণে মােট ১২ টি চূড়া রয়েছে। তার উপরের ধাপে ৮ টি চূড়া ও তৃতীয় তলার ছাদে ৪ টি চূড়া এবং সবশেষে একদম উপরে ১ টি চূড়া রয়েছে।
লালজী মন্দিরের দক্ষিণ দিকের বাড়ানাে অংশে রয়েছে জগমােহন ও নাটমন্দির। লালজী মন্দিরের পূর্ব ও পশ্চিমদিকে রয়েছে দালানযুক্ত ঢাকা বারান্দা। মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের জন্য পূর্বদিকে রয়েছে একটি কাঠের দরজা। এই দরজা দিয়েই গর্ভগৃহে প্রবেশের পরেই ডানদিকে রয়েছে সিঁড়ি, যার সাহায্যে মন্দিরের উপরে ওঠা যায়। লালজি মন্দিরের দেওয়ালের সর্বত্রই রয়েছে টেরাকোটার ফলক। যেমন উত্তর দিকের দেওয়াল জুড়ে পুরােটাই শিবলিঙ্গ ও বিভিন্ন ফুলের কাজ। মন্দিরের দক্ষিণ দিকের ঢাকা বারান্দার দেওয়ালে রয়েছে লঙ্কাযুদ্ধ। এছাড়াও বারান্দার সামনের খিলানে রয়েছে স্বপরিবাসে দুর্গা, দক্ষিণা কালী, বালগােপাল, জগদ্ধাত্রী দেবী। তবে মন্দিরের দেওয়ালের কোনগুলিতে খাড়া করে লাগানাে ‘মৃত্যুলতা’র ফলক দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। এছাড়াও টেরাকোটার ফলকে রয়েছে অশ্বারােহী সৈন্য, উঠের পিঠে সামরিক বাহিনী, মল্লযুদ্ধ, শিকারযাত্রা।
মন্দিরের বিগ্রহ রাধাকৃষ্ণের দুই পাশে রয়েছে বালগােপাল। আজও নিয়মিত এই মন্দিরে পুজো করা হয়। এখানকার প্রধান উৎসব জন্মাষ্টমী। এছাড়াও এখানে মহাসমারোহে রাসযাত্রাও পালিত হয়। ২০২০ সালের আগস্টে ভারতীয় ডাক বিভাগ বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের উপর ৭ টি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে কালনার এই প্রাচীন লালজি মন্দির। যা ইতিহাসের পাতায় এই মন্দিরটির গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি করেছে।
Discussion about this post