প্রতিবেদক মীর মনাম হোসেন, বাংলাদেশ
মাসের পর মাস অপেক্ষার শেষে যখন হেমন্ত নামে ছেউড়িয়ার আকাশে। তখন মাজার জুড়ে রঙিন আলো, মানুষের ভিড়, নানা ধরনের খাবার, কাঠের পুতুল, আর ধূপের গন্ধ ও গানের সুরে ছড়িয়ে পড়ে এক নিদারুণ মুগ্ধতা। সাদা, লাল, নীল আলোয় ঝলমলে হয়ে ওঠে লালন শাহ মাজার। পাশেই নদীর পাড়ে চলে বাউলদের দোতারা ও খমকের সুর। যার মাঝে চলে তিনদিনের রাতভর গান আর আলোচনা। খোলা মঞ্চের সামনে কেউ গভীর মনোযোগে শুনছে। কেউবা গাইছে। আবার কেউবা হারিয়ে যাচ্ছে লালনের ফেলে রাখা আধ্যাত্মিক দর্শনে। এখানে কেবল গান নয়। এই মিলনমেলায় ছড়িয়ে যায় এক বিশেষ দর্শন, জ্ঞান, আর উপলব্ধি।

এই বড় আয়োজনে যোগ দেন দেশ-বিদেশের সাধক, শিল্পী, আর অসংখ্য অনুরাগী। বাউলরা সহজ ভাষায় মনের গভীর থেকে গান করেন। দর্শকরা শুধু শুনেই থেমে থাকেন না। তারা সেই সুরে নিজেদের মনের প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজেন। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠেন লালনের মুক্ত চিন্তায়। তাই বলা যায়, লালন মেলা শুধু একটা উৎসব নয়। এটি এক চিন্তাধারার উদযাপন। যেখানে সুর, কথা আর ভাবনার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে এক ধরনের সমতার বোধ।

এই মেলার মাঝেই মনে আসে ফকির লালনের জীবনকাহিনি। যা আজও অনেকের কাছে অস্পষ্ট। শোনা যায়, হিন্দু ব্রাহ্মণপরিবারে জন্ম নেওয়া ছোট্ট লালনকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আর সেখান থেকে উদ্ধার করেন এক মুসলিম পরিবার। তিনি কখনও নিজের পরিচয়কে ধর্ম কিংবা জাতিতে আবদ্ধ রাখেননি। বরং নিজেকে বলতেন শুধু “মানুষ”। তাঁর গান ও দর্শনও সেই মানবিকতারই প্রমাণ। যেখানে প্রশ্ন করা হয় জাত, ধর্ম, আর সামাজিক বিভেদকে। তাঁর কণ্ঠে ওঠে, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে… দেখলাম না এই নজরে”।

১৮৯০ সালে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর শিষ্যরা প্রথম ছেউড়িয়ার মাটিতে স্মরণোৎসবের আয়োজন করেন। সেই থেকে প্রতিবছর কার্তিক মাসে তিনদিন ধরে এই স্মরণোৎসব চলে আসছে। যা আজ রূপ নিয়েছে জাতীয় পর্যায়ের এক ঐতিহ্যবাহী মেলায়। আজকের দিনে সরকার এই দিনটিকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মেলার প্রতিদিন বিকেলে শুরু হয় আলোচনা সভা। সন্ধ্যায় শুরু হয় বাউল গান। যেখানে অংশ নেন দেশের নানা প্রান্তের শিল্পীরা। মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই মেলা শুধু ঐতিহ্য রক্ষার জায়গা নয়। এটি আজও জীবন্তভাবে মানুষের মধ্যে লালনের সেই চেতনাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেখানে সবাই একসঙ্গে গাইছে সমতার গান, ঐক্যের গান। এখানেই লালনের দর্শন হয়ে ওঠে জীবন্ত সত্য। আর তাঁর মাজার শুধুই একটি স্থাপনা নয়। এটি মানবতাবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।







































Discussion about this post