সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীও এগিয়ে চলেছে নিজের তালে। কিন্তু সমাজ সব ক্ষেত্রে মেলাতে পারেনি ছন্দ। তাই তো এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও নারীদের বিচার করা হয় সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে নারীদের ত্বকের রং থেকে দেহের লোম – সবই হতে হবে ‘পারফেক্ট’। আর যদি বলা হয় এমন পৃথিবীতেই আত্মবিশ্বাসের শিখরে অবস্থান করছেন এমন এক নারী, যাঁর নাকি মুখভর্তি দাড়ি? শুধু অবাকই হবেন না, নিশ্চয়ই অবিশ্বাসও করবেন! কিন্তু এটি সত্যি। তিনি হলেন গিনেস বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী, ফ্রিল্যান্সার মডেল ও মোটিভেশনাল স্পিকার হরনাম কৌর।
তবে এই পর্যন্ত তাঁর যাত্রাপথ স্বাভাবিকভাবেই মসৃণ ছিল না। তাঁর বয়স যখন মাত্র বারো বছর, তখন পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) ধরা পড়ে। ফলে ছোটবেলা থেকেই তাঁর শরীর ও মুখের লোম বৃদ্ধি পায়। একজন মেয়ের শরীরে পুরুষালি বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতির কারণে তাঁকে শিকার হতে হয়েছে মানসিক নির্যাতনের। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তিনি অনেক রকম চেষ্টা চালান। ওয়্যাক্সিং থেকে শুরু করে পুরুষের ছদ্মবেশ – বাদ রাখেননি কিছুই! কিন্তু লাভ হয়নি। একসময় মানুষের কটূক্তির ভয়ে তিনি বাড়ির বাইরে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। চেষ্টা করেছেন আত্মহত্যারও। অবশেষে একটি ঘটনায় তাঁর জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়।
জীবনের এক কঠিন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে তিনি পা রাখেন আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটিতে। সেখানে ওয়ার্ল্ড প্রাইড এনওয়াইসিতে হাজির হয়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে তিনি প্রথমবার নিজের বক্তব্য রাখেন। মনে মনে তিনিও উপলব্ধি করেন, গুটিয়ে থাকা নয়, বরং নিজেকে গ্রহণ করতে পারার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমাধান। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৬ বছর বয়স থেকে তিনি পূর্ণ দাড়ি রাখতে শুরু করেন। ২৪ বছর বয়সে তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠা দাড়িযুক্ত নারী হিসেবে রেকর্ড গড়েন। ২০১৪ সালে তিনি লণ্ডন ফ্যাশন উইকের র্যাম্পে হাঁটেন। বিশ্ব বিখ্যাত ম্যাগাজিন কসমোপলিটান ও গ্ল্যামারের প্রচ্ছদেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
পাশাপাশি সমাজের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি অন্যান্য নারীদেরও নিজেদের শরীর নিয়ে লজ্জিত না হতে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। বিবিসি থ্রি-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এই প্রসঙ্গে কথা বলেন। শৈশবের মানসিক নির্যাতনের দিনগুলো পার করে আজ তিনি যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে গ্রহণ করেছেন ও পৃথিবীর সামনে মেলে ধরেছেন, তা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক। বিশ্বের লাখ লাখ নারীকে তিনি বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন যে আসল সৌন্দর্য ও শক্তির উৎস শরীর নয়, তা আসলে মন। এই বিশ্বাসে ভর করেই হয়তো মানুষ একদিন আরও সহনশীল হয়ে উঠতে পারবে!
Discussion about this post