প্রায় চার কোটি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, তা অবশেষে স্বীকৃতি পেল। ভাষাটির নাম কুড়মালি। এই ভাষায় প্রধানত কথা বলা হয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অসম এবং ছত্তিশগড় ও বিহারে। দীর্ঘ দিনের আন্দোলন, বহু চড়াই-উতরাই, বহু বিক্ষোভের হাত ধরে অবশেষে এ রাজ্যে স্বীকৃতি পেল এই কুড়মালি ভাষা। সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, ছত্তিশগড় সহ প্রায় চার কোটি মানুষ কুড়মালি ভাষায় কথা বলেন। বাংলা ভাষায় যেমন হিন্দি আগ্রাসন, ইংরেজি আগ্রাসন? তেমনই বাংলা ভাষাও আদি জনজাতিদের মাতৃভাষা গিলে ফেলছে। সেই তালিকায় কুড়মালি, সাঁওতালি, মুন্ডারি, হো, রাজবংশী ভাষা রয়েছে। উচ্চবর্ণকুলের এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুধু বাংলার নয়, সারা ভারতের আদিম সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার জন্য একাই একশো।
এই প্রথম সেই কুড়মালি ভাষায় রবি ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকাশিত হল। শুধুমাত্র কুড়মালি ভাষাই নয় কামতাপুরি, রাজবংশী ভাষাও স্বীকৃতি পেল রাজ্য বিধানসভায়। কুড়মালি ভাষার উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন এটি বাংলার অপভ্রংশ, তো কারও মতে ওডিশি ভাষার অপভ্রংশ হল কুড়মালি। মালদহের গৌড় কলেজের বাংলার অধ্যাপক – ক্ষিতীশ মাহাতোর দাবি, ‘চতুর্দশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ কুড়মালি শব্দ এবং ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের লক্ষণ স্পষ্ট ভাবে’।
কুড়মালি ভাষার নিজস্ব কোনও লিপি নেই। কিছু কিছু বিশেষ অঞ্চলে – দেবনাগরী, বাংলা ও ওডিশি হরফ ব্যবহার করা হয়। ঝাড়খণ্ডের বেশ কিছু কলেজে আই.এ থেকে স্নাতক স্তরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এমএ পর্যন্ত কুড়মালি ভাষাটি পড়ার সুযোগ আছে। স্নাতকোত্তর স্তরে অবশ্য কেবল দেবনাগরী ও ইংরেজি রোমান হরফে পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। কুড়মালি লোকসাহিত্য ও ঝুমুর গানের ধারাটিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এই সব এলাকায় ঝুমুরগানের জনপ্রিয়তা অত্যাধিক। কুড়মালি ভাষায় লিখিত সাহিত্যের সংখ্যা অপ্রতুল। ঝাড়খণ্ডের বেতার ও দূরদর্শনে কুড়মালি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়।
এই ভাষার কবিদের আছে কিছু অমর সৃষ্টি। কুড়মালি ভাষার কবি সুনীল মাহাতো, যার অমর সৃষ্টি – ;পিন্ধারে পলাশের বন’। নানাপ্রকার লোকনৃত্য যেমন ছৌ নাচ, কাঠি নাচ, বুলবুলি নাচ, নাচনি নাচ, দাসাই নাচ এবং বিভিন্ন লোকসঙ্গীত যেমন টুসু গান, ঝুমুর গান, ভাদু গান, বাউল গান, সোহরায় গান, বছরভর নানা আনন্দ-বিষাদের উৎসব, পরব, পুজো-পার্বণ অঞ্চলের লোক, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। শুধুমাত্র এই ভাষাই নয়, এই জনজাতির বৈবাহিক অনুষ্ঠানের মধ্যেও যেন এক আলাদা মায়া জুড়িয়ে আছে ।
Discussion about this post