‘কুরকুট’ নামের সঙ্গে আমরা হয়ত এখনও সেভাবে ঠিক পরিচিত নই। কিন্তু জানেন কি খাদ্যগুণের পাশাপাশি নানা ভেষজ গুণও রয়েছে এই কুরকুটের? পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলির জীবিকা নির্বাহের সবথেকে পরিচিত উপায় হল কুরকুট সংগ্রহ করা। এই কুরকুট হল এক ধরণের পিঁপড়ের ডিম। ‘উইভার এন্ট’ নামক এই পিঁপড়ে, স্থানীয় সাঁওতালি ভাষায় ‘হাও’ বা ‘হাউ’ নামেও পরিচিত। কমলা রঙের এই পিঁপড়ের দল বড় বড় গাছের মগ ডালে ঘর বেঁধে বাস করে। মগডালে বাসা বাঁধতে এদের লার্ভা থেকে নিঃসৃত হয় এক প্রকার সিল্ক। তা দিয়ে তিন চারটে পাতাকে একসঙ্গে জুড়ে সেলাই করে একটি থলির আকারে ঘর বানিয়ে সেখানেই থাকে এরা। শীত ও বর্ষা শুরুর আগে গাছের উঁচু ডালে সাদা চালের মত অসংখ্য ডিম পেড়ে রাখে এই পিঁপড়ের দল। এই ডিম গুলোই কুরকুট নামে পরিচিত। এই কুরকুটের চাটনি জঙ্গলমহল এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়ও বলা চলে।
কুরকুটের চাটনি তৈরির একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। চার চামচ কুরকুটের সাথে কাঁচা লঙ্কা, পুদিনা পাতা, অল্প পেঁয়াজ এবং রসুনের টুকরো বেটে, কাঁচা সরষের তেল আর প্রয়োজন মতো নুন মিশিয়ে তৈরি হয় কুরকুটের চাটনি। অনেকেই এই চাটনি শাল পাতায় মুড়িয়ে আগুনে ঝলসে খেতে পছন্দ করেন। আবার অনেকেই এর সঙ্গে একটু সরষে বেটে খেতেও বেশ ভালবাসেন। শুধুমাত্র খাদ্যগুণই নয়, একাধিক ঔষধি গুণও রয়েছে কুরকুটের। তাই খাবারের পাশাপাশি ভেষজ ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয় কুরকুট। মাছ ধরার সময় কুরকুট দিয়ে টোপও তৈরী করা যায়। এছাড়াও ভিটামিন সি’তে ভরপুর কুরকুট। রয়েছে ক্যালসিয়ামও। সাধারণ সর্দি-কাশিতে এই দুটি উপাদান খুবই কার্যকরী। শীতকালে শীতের মোকাবিলায় কুরকুটের ঝোল বিশেষ কাজ দেয় বলেও বিশ্বাস করে স্থানীয় কিছু শবর জনগোষ্ঠীর লোকজন।
শীতকালে জঙ্গলমহলের প্রায় প্রতিটি হাটেই বিক্রি হয় কুরকুট। গ্রাম থেকে গ্রামে কুরকুট ফেরি করেও বেড়ান অনেকে। জঙ্গলমহলের স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে চাল ডাল বা অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে কুরকুটের খুব একটা পার্থক্য নেই। রোজকার পছন্দের একটি খাবার হিসেবেই তাঁরা কুরকুট কিনে নিয়ে যান। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে এই কুরকুট বিক্রি হয়। কিন্তু এ হাত সে হাত ঘুরে দুর্গাপুর, আসানসোল, বারাসাত ও দমদম এলাকার বিভিন্ন আড়তে রাখা কুরকুটের মূল্য দাঁড়ায় প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। ফলে স্বভাবতই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা। তাই তাঁরা চান প্রকৃতিকে বাঁচিয়েও রোজকার আর্থিক স্রোতে মিলিত হয়েই বেড়ে উঠুক কুরকুটের বাজার। জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের আজও আশা, সরকারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগে বাজারের মূল স্রোতে কুরকুট একদিন সঠিক স্বীকৃতি পাবেই।
Discussion about this post