শ্রীরামপুরে চলছে ক্ষেত্রমোহন সা-র মেলা। পঞ্চাশ নয়, আশি নয়, সোয়া একশো বছর বয়স তার। আজকের দিনে মেলাটিকে দেখলে আর পাঁচটা সাধারণ মেলার মতই মনে হয়, কিন্তু এর ইতিহাস খুঁজলে বোঝা যায় এই মেলার তাৎপর্য কী রকম। সময়ের সাথে সাথে মেলার আকার, ধরণ, উদ্দেশ্য সবকিছুই কেমন যেন পাল্টে গিয়েছে। তবে এখনও নিয়ম করে প্রতি বছরের শিবরাত্রি থেকে প্রায় একমাস ধরে চলে এই মেলা।
শ্রীরামপুর স্টেশনের কাছে ক্ষেত্রমোহন সা স্ট্রিটে অবস্থিত প্রাচীন মেলাবাড়ি। প্রায় আট বিঘা জমি, একটি পুকুর এবং একটি মন্দির; একে কেন্দ্র করেই চলে এই মেলা। পাশেই রয়েছে ক্ষেত্রমোহন সা-এর বহু বছরের পুরনো বসত বাড়ি। তিনিই এই মেলার স্রষ্টা। তাঁর পরিরারের লোকজনের দাবি, পূর্বপুরুষ ক্ষেত্রমোহন সা গোদাবরীতে স্নান করতে গিয়ে একটি শিবলিঙ্গ পেয়েছিলেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৮৯৭ সালে সেটি তিনি শ্রীরামপুরে প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বছরেই তিনি মেলা শুরু করেছিলেন। মেলার নাম হয় ‘শ্রী শ্রী শিবশঙ্কর জীউ কৃষি কলা শিল্প প্রদর্শনী ও মেলা’। তবে স্থানীয় লোকজনের কাছে এই মেলা পরিচিত ‘ক্ষেত্র সা’ বা ‘ক্ষেত্রমোহন সা-এর মেলা’ হিসেবেই। আগে এটিকে ‘সঙতলার মেলা’ও বলা হত। পুরনো মন্দির ও নাটমন্দির মেলাবাড়ির অন্যতম ঐতিহ্য। মেলাবাড়ির ভিতরে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মন্দির। প্রধান আরাধ্য দেবতা শিব। তাছাড়াও রয়েছে কষ্টিপাথরের কালী, অষ্টধাতুর সূর্যদেব, পাথরের অন্নপূর্ণা, রাধাকৃষ্ণ, গণেশ, রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, হনুমান এমনকি মহাবীরের মূর্তিও। মন্দিরের দেওয়ালে রয়েছে সুদৃশ্য পোড়ামাটির বিভিন্ন কাজ। সাম্প্রতিক আমফান ঝড়ে মন্দিরের যথেচ্ছ ক্ষতি হয়েছে, ধ্বসে পড়েছে মন্দিরের কড়ি-বরগার একাংশ। মূল দরজা সেগুন কাঠের। দরজায় এখনও টিকে ধাতুর কারুকাজ।
শিল্প ও কৃষির সমন্বয়ে এই মেলার জন্ম। শিবরাত্রির দিন থেকে শুরু হয়ে এই মেলা চলে দোল পর্যন্ত, টানা এক মাস। সকাল-বিকেল দু’বেলাই পসরা সাজান দোকানিরা। আগে পুতুল নাচ হত। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল দিয়ে রামায়ণ ও মহাভারতের দৃশ্যাবলীরও প্রদর্শন হত। বর্তমানে সেসব বিলুপ্ত প্রায়। কয়েকটি মাটির পুতুল ছাড়া কিছুই নেই তেমন। তবে এখনও চলে কৃষিজ ফসলের প্রদর্শনী এবং আঞ্চলিক শিল্পীদের চিত্রশিল্পের প্রদর্শনী। আগে এক সময় হস্তশিল্প ও কুটীর শিল্পের প্রদর্শনীও হত। বর্তমানে অনুষ্ঠানটি বজায় থাকলেও সমস্ত ব্যাপারটিই স্তিমিত, কোন মতে টিকে আছে মাত্র। ধর্মশালা, চিকিৎসক, অবৈতনিক বিদ্যালয় সবই ছিল এক সময়ে। পরাধীন ভারতে হুগলি ছাড়াও বর্ধমান, অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা, হাওড়া এবং কলকাতা থেকেও প্রচুর মানুষ আসতেন। অনেকে হাতি-ঘোড়া-উট নিয়েও আসতেন এমন শোনা যায়। দরিদ্রদের পাত পেড়ে খাওয়ানো হত। সময়ের সাথে সাথে কমেছে মেলার জৌলুস। মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে রাস্তার ধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে দোকান বসত। নয় নয় করে শ’তিনেক অস্থায়ী দোকান হত। বর্তমানে মেলার পরিধি ছোট হয়েছে, কমেছে দোকানের সংখ্যা। তবুও গৃহস্থালীর নানান জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা, বিভিন্ন খাবার-দাবার, জিলিপি, বাদামভাজা, কাটি ভাজা নিয়ে আজও বেঁচে মেলাটি।
ক্ষেত্রমোহন ও তাঁদের বংশধরদের আহ্বানে এই মেলাবাড়িতে নানা সময় এসেছেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর ও বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মতো ব্যক্তিত্ব। মেলা প্রাঙ্গণের প্রবেশপথে একসময় নহবত বসত। সেই জায়গাটিতে আজ বট, অশত্থ আর আগাছায় ভর্তি। দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে এই মেলার প্রচলন করেছিলেন ক্ষেত্রমোহন সা। কালের স্রোতে সব কিছু ফিকে হয়ে গেলেও জীর্ণ মেলাবাড়ি আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
তথ্যসূত্র: ১) শ্রীরামপুর পরিচিতি, শ্রীরামপুর পৌরসভা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ২) অশোক মিত্র (সম্পাদক): পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা, দ্বিতীয় খন্ড, অনুপ্রেস, ১৯৬৮৩) শ্রীকৃষ্ণগোপাল পাকড়াশী: তিন শতকের রিষরা ও তৎকালীন সমাজ চিত্র, স্মৃতি প্রেস, ১৩৮২ বঙ্গাব্দ
Discussion about this post