ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনেছিলেন শবর জাতির করা চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। বেশ কয়েকবার একই ঘটনা শুনে প্রশ্ন করেছিলেন,”এই জাতির লোকেরাই কেন চুরি করছে? অন্যদের কথা তো তেমন শুনতে পাই না।” উত্তরে দাদু বলেছিলেন যে মানুষ চুরি করে দুটি কারণে। এক পেটের দায়ে, দুই শিক্ষার অভাবে। শিক্ষার অভাবে এই জাতিকে মানুষ ঠকাতো বহুভাবে। বেশিরভাগ সময়েই অপরাধের দায় এসে পড়তো এই জাতির ওপরেই। ইংরেজ আমলে শবর জাতির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ বা ‘হিংসা-প্রবণ জাতি’।
অরূপ মুখোপাধ্যায় সেদিন তাঁর দাদুকে বলেছিলেন যে চাকরি পেলে স্কুল গড়বেন শবরদের জন্য। শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবেন তাদের বাড়িতে। দাদু তাঁর কথায় আমল না দিলেও কথা রেখেছে সেদিনের বলা কথা রেখেছে বছর পাঁচেকের সেই ছেলেটি। প্রায় একা হাতে পুরুলিয়ার পুঞ্চায় শবর শিশুদের জন্য একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। জীবনের রঙ মাখাচ্ছেন অন্ধকারে থাকা লোকগুলির শরীরে।
দিন কয়েক আগেই ইতিহাস গড়েছেন পুরুলিয়ার শবর কন্যা রমনিতা। বরাবাজার থানার ফুলঝোর গ্রামের রমনিতা শবর পুরুলিয়া জেলায় প্রথম ইতিহাসে ডিসটিংশন নিয়ে অনার্স গ্র্যাজুয়েট হলেন। শুধু রমনিতাই নয়, এই ফুলঝোর গ্রামেরই শকুন্তলা শবর, হিন্দি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বসুমতী শবর, ইংরেজি অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দুজনেই পরে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পটমদা ডিগ্রি কলেজে। ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ থেকে মহিলা স্নাতক, শবরদের এই লড়াইয়ের কান্ডারী বলা চলে অরূপ মুখোপাধ্যায়কে।
১৯৯৯ সালে কলকাতা পুলিশ কনস্টেবল পোস্টে যোগ দেন অরূপ। প্রথম মাস থেকেই স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্যে টাকা জমাতে শুরু করেন। ২০১০ সালের তার জমানো টাকার পরিমাণ এসে দাঁড়ায় আড়াই লক্ষে। ঠিক করেন শবর শিশুদের জন্য স্কুল তৈরি করবেন। সেই বছরেই পাশে পান পাশের গ্রামেরই ক্ষিরোদ শশী মুখোপাধ্যায়কে। যিনি বিনা-পয়সায় নিজের জমি স্কুল করার জন্য তাকে দিয়ে দেন। ২০১১ সালে সাড়ে চার লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় পাঁচটি ঘর। ১৫ জন শবর শিশু নিয়ে শুরু হয় তার স্বপ্নের,’পুঞ্চা নব-দিশা মডেল স্কুল’এর।
বর্তমানে স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা ১২৬ জন। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত পড়ানো হয় এই স্কুলে। তারপর ছাত্ররা ভরতি হন সেখানকারই সরকারী স্কুলে। যদিও তারা থাকেন অরূপবাবুর স্কুলেই, তাদের খাওয়া-পড়ার সমস্ত দায়িত্ব তাঁর। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর থেকে প্রতি মাসে সাহায্য পেলেও তাঁর বেতনের সিংহভাগই চলে যায় এই স্কুলের বাচ্চাদের পেছনে। এই মহান উদ্যোগ নেওয়ায় ‘হাই রেঞ্জ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’-এ নাম উঠে গিয়েছে তাঁর। কাজের স্বীকৃতি হিসাবে শারজা থেকে পেয়েছেন ‘ব্র্যাভো ইন্টারন্যাশনাল বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ পুরস্কার সহ অন্যান্য পুরস্কারও। যদিও এতকিছুর পরেও ঘরের লোকের কাছেই ব্রাত্য তিনি। এখনও অবধি পাননি সরকারী কোনও স্বীকৃতিও।
ঘরের মানুষের কাছে তিনি শুধু ব্রাত্যই শুধু নন, শবরদের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে কিছু সহকর্মীর করা অভিযোগে বিভাগীয় তদন্তের মুখেও পড়েছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডিউটিতে ফাঁকি দিয়ে সেবামূলক কাজ করে চলেছেন তিনি। যদিও তাতে দমে যাওয়ার পাত্র তিনি নন। সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে তাঁর একটাই স্বপ্ন, শবর জাতিকে আলোয় ফেরানো।
Discussion about this post