এপার বাংলা আর ওপার বাংলার মধ্যে দূরত্ব আর কতটুকু? সে রাস্তার কথাই বলুন বা মনের! দেশভাগের এতবছর বাদেও যেন দুই বাংলার মানুষের মনে কাজ করে অদৃশ্য কোনও বাঁধন। কাঁটাতার মুছে ফেলতে পারেনি সবটুকু। অবিভক্ত বাংলার স্মৃতি ও ঐতিহ্য আজও বয়ে চলেছে আমাদের ভাষা-খাদ্য-শিল্প ও আরও কত কিছুর মাধ্যমে! তেমনই উল্লেখযোগ্য একটি মাধ্যম হল বাংলাদেশের নদীপথের সরকারি প্যাডেল স্টিমার বা রকেট সার্ভিস।
দেশভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে ঢাকায় নৌ-পথে যোগাযোগের জন্য এই নৌ-সার্ভিসটি চালু করা হয়। এই রকেট স্টিমার সার্ভিসের সুনাম সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকদের প্রথম পছন্দ বাস-ট্রেন নয়, বরং ছিল এই রকেট স্টিমার সার্ভিস। প্যাডেল স্টিমার আর জাহাজগুলো ঢাকার প্রাচীন নদীবন্দর বুড়িগঙ্গার তীরে সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। জনৈক ইসমাইল হোসেনের থেকে জানা যায়, ‘কমলা রকেট’ নামক প্যাডেল স্টিমারের সার্ভিসের রুটটি হল : ঢাকা – চাঁদপুর – বরিশাল – ঝালকাঠি – কাউখালী – হুলারহাট – চরখালী – বড় মাছুয়া (মঠবাড়িয়া) – সান্ন্যাসি – মোড়লগঞ্জ পর্যন্ত। এখন প্যাডেল স্টিমার সপ্তাহে মাত্র একদিন, বুধবার খুলনা যায়। শুক্রবার ও রবিবার অন্যান্য রুটে স্টিমার চলাচল বন্ধ থাকে।
দেশের অন্যতম দীর্ঘ এই নৌ-পথে ধান-নদী-খালের সৌন্দর্য দেখার জন্য আপনাকে পাড়ি দিতে হবে বরিশাল। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, মেঘনা, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, বিষখালী, গাবখান, সন্ধ্যা, কালিগঙ্গা, কচা নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি উপভোগ করা যাবে স্টিমারের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার। রকেট সার্ভিসের খাবার ব্রিটিশ আমল থেকেই বেশ জনপ্রিয়। এদের ইংলিশ আর বাংলা খাবারের মান বেশ উঁচু মানের। তখনকার নামীদামী সব রেস্তোঁরার খাবারকে হার মানাতো এই খাবার। এখনো টিকে আছে সেই ফুড সার্ভিস। অগ্রিম অর্ডারের বেসিসে খাবার রান্না করা হয়। ডাইনিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিটি স্টিমার আর জাহাজে। এদের সামুদ্রিক আর নদীর তাজা মাছের কাটলেট বেশ জনপ্রিয়, সাথে রয়েছে কোরাল মাছের কাটলেট! হেড অফ ক্যাটারিং মুহাম্মদ আলী হোসেন (এম.ভি. মধুমতি ক্যান্টিন চীফ) জানান, বর্তমানে প্যাডেল স্টিমার, রকেট ও জাহাজ এম. ভি মধুমতিতে এই ক্যাটারিং সার্ভিস চালু রয়েছে। পাওয়া যায় স্ন্যাক্স, বাংলা ডিনার, ইংলিশ ডিনার। স্ন্যাক্সে রয়েছে বিভিন্ন খাবার; যেমন ফিস কাটলেট, চিকেন কাটলেট, ফিস ফ্রাই (ইলিশ, কোরাল মাছ), স্মোক ইলিশ, চিকেন ফ্রাই ইত্যাদি। ইংলিশ ডিনারে মটন ও চিকেনের পাশাপাশি রয়েছে স্যুপ, ফিস ফ্রাই, রুটি, জেলী, পুডিং, বয়েল্ড ভেজিটেবল, চা, থাই সুপ। বাংলা ডিনারে রয়েছে ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা, দো-পেঁয়াজা, ডিম, সবজি, চিকেন।
কালের বিবর্তনে আর অবহেলায় নৌ-পথগুলির নাব্যতা হারিয়ে গেছে, দখল হয়ে গেছে নদী। তবু শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে এই প্যাডেল স্টিমার আর ফুড সার্ভিস। কিন্তু বার্ধক্যে পৌঁছানোর সাথে সাথে এই প্যাডেল স্টিমার স্বাভাবিক নিয়মেই হারিয়েছে তার জৌলুস। বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে, যে কোনো দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে ঐতিহ্যবাহী এই ভাসমান স্টিমার! ইতিহাস-বিজড়িত এই নৌ-সার্ভিসকে চালু রাখতে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে সরকার, এই আশা রাখি।
সম্পাদনা – সুমেধা কর মহাপাত্র, চিত্র ঋণ – মেহবুব হাসান
Discussion about this post