কলকাতার লেনিন সরণি—এক চিলতে ফুটপাথ, সারি সারি দোকান আর ভিড় ঠাসা রাস্তার হট্টগোলে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়। পায়ে পায়ে চলতে চলতে কেউ হয়তো খেয়ালই করে না, এই পথের ধুলো মেখে একসময় হেঁটেছেন রাজপুরুষ, সওদাগর আর সাধারণ মানুষেরা। আধুনিকতার ঝলমলে মুখোশের আড়ালে টিকে আছে সময়ের গায়ে আঁচড় কেটে যাওয়া সেই দিনগুলো। এ পথের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য আর স্মৃতিচিহ্ন, যার মধ্যে অন্যতম হল চার্চ অব সেক্রেড হার্ট অব জিসাস।
প্রায় দুই শতাব্দী পুরনো গির্জা। আর এই গির্জার স্থাপনের ইতিহাসটাও যেন একেবারে রূপকথার মতো। জানা যায়, ডোনা পাসকোয়া ব্যারেটো ডি’সুজা নামে এক অভিজাত মহিলার মানত থেকেই এই গির্জার জন্ম। তার ছেলের কঠোর শাস্তি এবং পরে মানসিক অসুস্থতার কারণে দ্রুত মুক্তি পাওয়া—এই ঘটনাই তাকে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পথ দেখিয়েছিল। সেই মানতের ফলশ্রুতিতেই গড়ে ওঠে এই গির্জা, যার নকশা ও নির্মাণশৈলী এখনো মুগ্ধ করে দর্শকদের।
১৮৩৪ সালের ইস্টার স্যাটার ডে-তে এই গির্জা উৎসর্গ করা হয় ঈশ্বরের নামে। একসময় এটি পর্তুগিজ পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠলেও, পরে তা চলে যায় ভ্যাটিকানের অধীনে। সাহেব পাড়ায় গড়ে ওঠা এই গির্জায় বাঙালির আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে যারা গির্জার কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তাদের জন্য ভোরের আলাদা প্রার্থনা সভা ছিল। শহরের কোলাহল ছাপিয়ে গির্জার শান্ত পরিমণ্ডলে প্রবেশ করা যেন এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।
গির্জার স্থাপত্যে অতীতের ছাপ স্পষ্ট। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতার নগরায়নের ইতিহাস, যা চোখে আনে এক অন্য আলো। এই ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে স্যার চার্লস ডি’অলি নামক এক শিল্পীর নাম। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য ডি’অলি কলকাতার প্রথম যুগের নগরায়নের দৃশ্যকে তুলির টানে ধরে রেখেছেন। তার আঁকা ছবিতে ধরা পড়েছে চার্চ অব সেক্রেড হার্ট অব জিসাসের উঁচু চূড়া, রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, ইউরোপীয় অভিজাত ও সাধারণ পথচারীদের ভিড়।
ডি’অলির আঁকা ‘ভিউজ অব ক্যালকাটা এন্ড ইটস এনভিরন্স’ অ্যালবামের লিথোগ্রাফগুলো শুধু শিল্পকর্ম নয়, কলকাতার অতীতের নীরব সাক্ষ্য। তার ছবির মধ্য দিয়ে দেখা যায় কীভাবে গ্রাম কলকাতা ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল। ধর্মতলার সেই জমজমাট রাস্তার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা চার্চ আজও বহন করে সেই ঐতিহ্য।
আধুনিকতার বেগে বদলে যাওয়া শহরের মধ্যে দাঁড়িয়ে চার্চ অব সেক্রেড হার্ট অব জিসাস যেন এক নীরব প্রহরী। কলকাতার বহু গির্জার ভিড়ে এই চার্চ হয়তো ততটা আলোচিত নয়, কিন্তু এর স্থাপত্য, নির্মাণের পেছনের কাহিনি আর ঐতিহাসিক মূল্য সেইসব চেনা গির্জার চেয়েও আলাদা মর্যাদা বহন করে। শহরের বদলে যাওয়া মুখের আড়ালে এই গির্জা রয়ে গেছে এক নিরিবিলি আশ্রয় হয়ে।
Discussion about this post