বাংলার মাটি, নদী আর ভক্তির ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য অলৌকিক কাহিনি। প্রতিটি গ্রামের, প্রতিটি মন্দিরের পেছনে লুকিয়ে থাকে কোনও না কোনও কিংবদন্তি। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী বিথারী গ্রামেও রয়েছে এমনই এক দেবস্থানের ঠিকানা – খয়রা কালী মন্দির। এখানে দেবী কালীকে পুজো করা হয় খয়রা মাছের ভোগে, যা এই মন্দিরের নামের সঙ্গে চিরস্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। সাধারণ কোনও পূজাস্থল নয়, সাতশো বছরেরও পুরোনো এই মন্দির ভক্তি, ঐতিহ্য ও অলৌকিকতার এক অনন্য মেলবন্ধন।

ইতিহাস বলে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে কাশীর পণ্ডিত গোপাল সার্বভৌম চক্রবর্তী যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের আমন্ত্রণে রওনা দেন বেদপাঠের জন্য। যাত্রাপথে অমাবস্যার রাতে তিনি জঙ্গলে পথ হারিয়ে আসেন বিথারীর শ্মশান প্রান্তে। সেখানেই স্বপ্নাদেশে এক দেবী তাঁকে পুজোর নির্দেশ দেন। পরদিন সকালে গোপাল দেবীর নির্দেশ মতো কালীমূর্তি গড়ে পুজো করেন, কিন্তু বিসর্জনের সময় একের পর এক বাধা আসে। পুনরায় স্বপ্নে দেবী জানান, তিনি এই স্থানেই বিরাজ করবেন এবং গোপালকেই এখানে বসবাস করতে হবে। প্রতাপাদিত্য গোপালের জন্য জমি ও অর্থ দান করলে মন্দির গড়ে ওঠে। মন্দির সংলগ্ন স্বর্ণ নদী থেকে খয়রা মাছ ধরে মায়ের ভোগ নিবেদন শুরু হয়, আর সেখান থেকেই দেবীর নাম হয় ‘খয়রা কালী’। মুসলমান জেলেদের ধরা মাছ দিয়েই ভোগ দেওয়া হত – ধর্মীয় সহাবস্থানের এই ঐতিহ্য আজও এই মন্দিরের গর্ব।
খয়রা কালী মন্দিরের ইতিহাসে যুক্ত রয়েছে আরও দুই মহান নাম – রাণী রাসমনি ও শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। মন্দিরটি ছিল রাণী রাসমনির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের পৈতৃক ভিটের কাছেই। মথুরমোহন ও তাঁর স্ত্রী জগদম্বা মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে রাণীকে জানান। রাণী রাসমনি নিজ খরচে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করান ও নতুন প্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব দু’বার এই মন্দিরে এসেছিলেন, পুজো করেছিলেন ও গভীর ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই মন্দিরের মা অত্যন্ত জাগ্রত। একসময় গোয়ালবাথান গ্রামে যখন কলেরা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, তখন গ্রামের মানুষ খয়রা কালীর আরাধনা করেন এবং দেবীর কৃপায় কেউ প্রাণ হারাননি – এমন কথাই চলে আজও।
আজও অগ্রহায়ণ মাসের শেষ মঙ্গলবার খয়রা কালী মন্দিরে ভক্তদের ঢল নামে। মন্দির চত্বরে বসে বার্ষিক মেলা। মাঘ মাসের চতুর্দশীর রাতে রটন্তীকালী পুজোও হয় তান্ত্রিক মতে। আর সেই রাতে মাকে দেওয়া হয় খয়রা মাছের ভোগ। কালীপুজোর দিনও সাবেকি তন্ত্রমতে পুজো চলে, পাঁঠাবলি হয় ঐতিহ্য মেনে। সময় বদলেছে, কিন্তু বিশ্বাসের শিকড় অটুট। খয়রা কালী আজও বিথারীর মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মন্দির মাছ, মাটি ও মাতৃভক্তি মিলেমিশে গড়ে তুলেছে এক জীবন্ত ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।
Discussion about this post