দুর্গাপূজা, ‘পূর্ব গোলার্ধের রিও কার্নিভাল’। বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবকে ঘিরেই নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ইতিহাস। সেরকমই একটি ঝাড়খগ্রামের কনক দুর্গা মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাস ৪৩৫ বছরের পুরনো। ঝাড়গ্রাম থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ডুলুং নদী। নদীর তীরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কনক দুর্গা মন্দির।
ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। মূলত দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের আকার নেয়। ফলে এই সর্বজনীন পূজার ইতিহাস খুব পুরনো নয়। সেক্ষেত্রে পারিবারিক বা প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক মন্দিরের কথাই আসে। পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতেই আয়োজিত হয়। কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গাপূজা ‘বনেদি বাড়ির পূজা’ নামে পরিচিত। এছাড়াও এমন অনেক দেবীমণ্ডপ রয়েছে যেখানে উমা সারা বছরই বিরাজ করেন ভক্তদের করুণা প্রদানের জন্য। শুধু ঐতিহ্যই নয়, এই পুজোগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মিথও।
সেই কিংবদন্তি থেকেই কনক দুর্গা মন্দির সংলগ্ন স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই মন্দিরে আজও অষ্টমীর রাতে নিজেই নিজের ভোগ রান্না করেন দেবী স্বয়ং। বাংলা ৭৮৮ সনে তৎকালীন সামন্ত রাজারা প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন সামন্তরাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ, ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে। রানীর অষ্টধাতুর তৈরি কঙ্কণ, স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী এই কঙ্কণ থেকেই তৈরি হয় চার হাত ও ঘোড়ায় বসা দুর্গা মূর্তি। দেবী চণ্ডীর একটি লোকরূপ হল কনকদুর্গা। দেবীর চারটি হাত। ওপরের বামহাতে পানপাত্র, নীচের বামহাতে ঘোড়ার লাগাম। ওপরের ডানহাতে খড়্গ আর নীচের ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা। পুরনো আমলের যে মন্দির রয়েছে, সেটি বর্তমানে ভগ্নাবশেষ-মাত্র। প্রাচীন পঞ্চরত্ন মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়ায় একই চত্বরে তৎকালীন রাজা জগদীশচন্দ্র দেও ধবলদেবের উদ্যোগে পাশেই নতুন মন্দির নির্মিত হয় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে।
দেবী কনক দুর্গা স্বপ্নে রাজাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতিমার আকার কেমন হবে এবং কোন স্যাকরা তাঁকে মূর্তির রূপ দেবে। দেবীর নির্দেশ মেনে চিল্কিগড়ের শ্যাকরা যোগেন্দ্র কামিল্যাই তাঁকে নির্মাণ করেন এবং দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র ষড়ঙ্গী। রাজা, রাজ-পুরোহিত ও ধাতুশিল্পী যোগী কামিল্যা, তিনজনেই দেবীর একই রূপ দেখেছিলেন স্বপ্নে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীর বংশধররা দেবীর পুজো করে আসছেন। ষষ্ঠীতে ডুলুং থেকে ঘট ভরতি জল আসে। সারারাত মন্দিরের বাইরে বেলগাছের নীচে থাকে ঘট। সপ্তমীর সকালে কলসির জল দিয়ে ঘট শুদ্ধ করে হোম আরতির পর গৃহপ্রবেশ। আগে এখানে নরবলি হত। দেবীর নির্দেশে তা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও আজও অষ্টমীর দিন হয় পাঁঠা বলি।
মাও আমলে ২০০৭-২০০৮-য়ে দুবার চুরি যায় মূর্তি। নতুন করে তৈরি হয় অষ্টধাতুর মূর্তি। মন্দিরে বসে সিসিটিভি। মন্দির লাগোয়া বিশাল ভেষজের জঙ্গল। পরিচর্যার অভাবে দামী দামী ওষুধের গাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে গাছের রক্ষণাবেক্ষণে রাখা হয়েছে রক্ষী। তৈরি হয়েছে চেকপোস্ট। পর্যটন দফতরের বরাদ্দ কোটি টাকায় বন দপ্তরের উদ্যোগে কনক দুর্গা মন্দির এখন পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন মানচিত্রের অন্যতম স্থান। যদিও স্থানীয়দের অভিযোগ, সৌন্দর্যায়নের নামে কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করায় চিল্কিগড়ের আসল মজাটাই কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে।
Discussion about this post