“শব্দে জেগে ওঠে বিষ্ণুমন্দিরের টেরাকোটা”.. রোদে তপ্ত , আগুনে পোড়ানো মাটির সামান্য একখানি দলা,গায়ে সূক্ষ্ম হাতের কাজ। তাতেই খোদাই করা আছে একটা জাতির সমগ্র ইতিহাস! খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৪০০০সাল। প্যালিওলিথিক যুগ, মানবজাতি অতিযত্নে বেড়ে উঠছে পৃথিবীর পাঠশালায়। ধীরে ধীরে,মাটি রোদে শুকিয়ে সে তৈরী করল রান্নার পাত্র। টেরাকোটায় হাতেখড়ি। এগোল সময়,এগোল মানুষ সভ্য হওয়ার পথে। আর টেরাকোটায় লিপিবদ্ধ হল পদক্ষেপের প্রতিটি স্তর।
লাতিন শব্দ ‘টেরাকোটা’। ‘টেরা’ অর্থাৎ পৃথিবী বা মাটি আর ‘কোটা’ অর্থাৎ পোড়ানো। আক্ষরিক অর্থ বড্ড সাধারণ হলেও,এই টেরাকোটা বাস্তবে ইঙ্গিত দেয় এক বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যকে। সেই মহেঞ্জোদারো থেকে মল্লরাজার বিষ্ণুপুর, টেরাকোটার ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হয়েছে নগরী। কোথাও সে দেহের অলংকার, কোথাও সে সৃষ্টি করছে ভাস্কর্যের নতুন সংজ্ঞা। তবে বঙ্গদেশে বিষ্ণুপুরের দেওয়ালেই সীমাবদ্ধ নেই এই সৌন্দর্য্য। টেরাকোটার সৌন্দর্য্য ছড়িয়েছে তার শাখা-প্রশাখা। আর মানুষকে মুগ্ধ করেছে তার নিজেরই সৃষ্টি!
ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের অম্বিকা কালনা। পূর্ব বর্ধমানের কালনা শহর। রাজবাড়ি থেকে শুরু করে এখানকার মন্দিরের প্রতিটি ইট জানান দেয়, টেরাকোটা কী নিখুঁত সুন্দরী! সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের টেরাকোটার মূর্তি এবং এক একটি নকশার কাজ প্রমাণ করে দেবে ধৈর্য্য বিকল্পহীন। মূল মন্দিরের সামনে দেখা মিলবে ‘এক বাংলা’ মন্ডপের। মন্দিরের দালানে রয়েছে দুটি পূর্ণ স্তম্ভ এবং দুটি অর্ধ স্তম্ভের। প্রতিটি স্তম্ভকে সাজানো হয়েছে টেরাকোটার অলংকারে। ২৫ চূড়বিশিষ্ট এই মন্দিরের জমকালো ইটের গায়ে সৃষ্টি শিল্প তো সামান্য আঁকিবুকি নয়! সে সৌন্দর্যের মাইলফলক। কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দির। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা প্যারীকুমারী দেবী। সময়টা ১৮৪৯ সাল। মন্দিরের মূল কারিগর রামহরি মিস্ত্রি। তাঁর হাতেই নির্মাণ সোনামুখীর শ্রীধরজী’র পঁচিশচূড়া মন্দিরও। প্রতাপেশ্বর মন্দিরের দেওয়ালে ও টেরাকোটার কী নিঁখুত আঁচড়! রামায়ণের পটভূমি থেকে বিদেশিনীর দল, সেই টেরাকোটার দেওয়াল যেন নিজেই সময়ের এক দলিল।
পঞ্চবিংশতি রত্ন কালনার লালজী মন্দির। রত্ন অর্থাৎ চূড়া।২৫টি চূর থাকায় এই নাম। কালনা রাজবাড়ী চত্বরের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরটি হল লালজী মন্দির। মূল মন্দিরের চারদিকে চারচালা ছাদ এবং দীর্ঘ খিলান বারান্দা। রামায়ণ থেকে শ্রীকৃষ্ণের লীলা, টেরাকোটায় সাজানো এক একটি কাহিনী। যে কাহিনীর হস্তাক্ষর আশ্চর্য জাগায় দর্শনার্থী মনে। কালনারই ১০৮ শিব মন্দির অথবা নব কৈলাস মন্দির। দুটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তের উপর নির্মিত এই মন্দির। পোড়ামাটি যে নেহাৎ ‘পোড়া’ মাটি নয়,এই মন্দিরের প্রতিটি ইটের টুকরো তার সাক্ষী। রামায়ণ, মহাভারত থেকে শিকার এর বর্ণনা কারিগর তা লিখে গেছে টেরাকোটার নিজস্ব ভাষায়।
মন্দিরের শহর কালনা। মহানগরী থেকে দূরত্ব খুব বেশী নয়। এখানকার একেকটি মন্দির যেন নিজেই একেকটি মিউজিয়াম!টেরাকোটার সৌন্দর্য চাক্ষুষ করতে অবশ্যই একবার কালনায় যেতেই হয়। কে জানে কোন গল্প উঁকি দেবে বর্ষপ্রাচীন ইট থেকে।
তথ্য ঋণ – শ্রদ্ধাঞ্জলী বর
Discussion about this post