‘বাংলার বাঘ’ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে কে না চেনে। বর্তমানে মুখোপাধ্যায় পরিবার কলকাতাবাসী হলেও কিন্তু আদিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার জিরাটে। হুগলি তখন ফরাসী ঘাঁটি। তাই ফরাসি শব্দ ‘জিরায়ৎ’ থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় জিরাট। এখানে অবস্থিত ‘গোপীনাথ জীউ’ এক মন্দির প্রতিষ্ঠার পরদিন ভোরেই নাকি, প্রভুর পদচিহ্ন দেখা যায় মন্দির চত্বরে।তাই জীউ এর ‘জী’, ‘ রা’ অর্থাৎ দান করা এবং ‘ট’ অর্থ পদ। এটিই হল ‘জিরাট’ নামের সার্থকতা। হাওড়া-কাটোয়া মেইন লাইনেই জিরাট স্টেশনটির অবস্থান। আজকের এই গ্রাম্য শান্ত পরিবেশটা কোনো একসময় লোকের গলা কাঁপা ভয়ের কারণ ছিল। জিরাটের আনাচে কানাচে আজও ছড়িয়ে রয়েছে বেশকিছু কিছু অজানা তথ্য। চলুন একবার চোখ বোলাই সেই ইতিহাসে।
আমাদের বাঙালি হিন্দু সমাজে বহুভেদে কালীর আরাধনা হয়ে থাকে। তারমধ্যে ডাকাত কালী হলেন সর্বশক্তির মূল আধার। তাই ডাকাতির আগে চলত বলি ,লাউ পোড়া ইত্যাদি সহযোগে দেবীকে একনিষ্ঠ ভক্তি প্রদর্শন। জিরাটে বেশ কয়েকটি কালী মন্দিরের হদিশ মিললেও, কালিয়াগড়ের বা কেলেগড়ের কালীমন্দিরটি বহু পুরোনো। এমনও শোনা যায়, গঙ্গার পশ্চিম পাড় থেকে এক ব্রাহ্মণ সন্তান জিরাটের এই অঞ্চলে পৌঁছোন এবং স্বপ্নাদেশেই গড়ে তোলেন এই কালীবাড়িটি। বংশ পরম্পরায় তাঁরা ছিলেন ‘মুখোপাধ্যায়’ বংশের। মন্দিরের ফলক নথি থেকে জানা যায় ,এখানে দেবী সতীর হাতের বালা বা বলয় পড়েছিল। তাই এটি বলয়োপ-পীঠ নামেও উচ্চারিত হয় লোকমুখে। এই কালিয়াগড়েই জমিদার কালিচাঁদের বিশাল মহল আবার এখানেই ছিল তার ডাকাতি ডেরা। শোনা যায় ,কালিচাঁদ মিশকালো অন্ধকারে কপালে সিঁদুর লেপে ও হাতে অস্ত্র নিয়ে বেরতো কেলে ডাকাত বেশে। পথযাত্রীদের পথ আটকাতো আর চলত লুটপাটের দামামা। রাতের ডাকাতিতেই গড়ে উঠেছিল তার জমিদারি সাম্রাজ্য। যদিও বর্তমানে, তার উত্তরপুরুষরা এই লোককথাগুলিকে অস্বীকার করেন।
বর্তমানে সেই ডাকাতি হুঙ্কার কিংবা হাড়হিম করা ভয় না থাকলেও, বেশ কিছু স্মৃতি আজও অক্ষত। তারমধ্যে কেলেগড়ের কালীমন্দিরের পরিচিতি অনন্য। হুগলী নদীটিও তার গতিধারা বদল করেছে। কিন্তু মন্দির সংলগ্ন ঘাটে ওঠা-নামা করার এক সিঁড়ি দেখে, এটি ঠাহর করাই যায় এখানে কোনো এককালে নদীর অবস্থান ছিল। মন্দিরের দেবীর অঙ্গরাগ হয় কিছু বছর ছাড়াই। কিন্তু পুরোনো কাঠামোটি আজও একই রাখা আছে।পঞ্চমুন্ডির আসনে সুসজ্জিতা এখানের আরাধ্যা দেবী। তন্ত্রমতে চলে পুজো। রাত্রে বলির চলটি এখন প্রায় নিষিদ্ধ। কিছু সীমিত বলি, বিশেষ অনুষ্ঠান ও মানতের অনুমতিও রয়েছে। কালিমন্দিরটি সাম্প্রতিক পরিবারের চেষ্টায় মাঝেমধ্যে সংস্কারও হয়ে থাকে। আর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটেটি এখন ‘আশুতোষ স্মৃতি মন্দির বালিকা বিদ্যালয়’।
Discussion about this post