‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে ব্রতীর মা সুজাতার কথা অনেকেই পড়েছেন। ঠিক এমনই গল্পের চরিত্র যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে জীবনের মাঝে। নিজের নাম ভুলে গিয়ে তিনি পরিচিত ‘শহীদের মা’ নামেই। বাংলাদেশের সেই জননী জাহানারা ইমাম যিনি লিখে রাখেন সত্যিকারের ইতিহাস, লিখে রাখেন বেদনা। জাহানারার সে যন্ত্রণা বিখ্যাত হয় ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামে।
তিনি লিখেছেন তাঁর সন্তান রুমিকে কুরবানী দেওয়ার কথা। প্রথম জীবনে রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও পরে তিনিই নিজস্ব দক্ষতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশ পেরিয়ে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে, নারীর স্বাধীকার প্রশ্নে লড়াইতে জারি ছিলেন জাহানারার মত মানবীরা। ১৯২৯ সালের ৩রা মে জন্ম হয় জাহানারার। রাঢ় বাংলার অভিজাত রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবারে বড় হওয়া তাঁর।
সাধারণের মধ্যে থাকলেও ধীরে ধীরে তাঁর স্বতন্ত্র আওয়াজ ধ্বনিত হতে শুরু করেছিল ষাটের দশকে। তাঁর কথা বর্ষিত হতে শুরু করে তার কলমের সাহায্যে। মূলত শিশু সাহিত্যিক হিসাবেই লেখার জীবন শুরু হয় জাহানারা ইমামের। ‘গজকচ্ছপ’, ‘সাতটি তারার ঝিকিমিকি’র মতো বই তিনি উপহার দিয়েছেন নতুন প্রজন্মকে। জাহানারা জানতেন, একটি শিশুকে না বুঝলে দেশকে বোঝা হয় না। এরই মাঝে জাহানারা স্থির করে ফেলেছিলেন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখবেন দিনলিপির আকারে। তিনি লিখতে শুরু করেন শিশু হারানোর যন্ত্রণার কাহিনী। যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের ছোটো ছেলে রুমিকে হারান।
পাক বাহিনীর অত্যাচারের শিকার যার স্বামী শরীফ ইমাম, বড়ো পুত্র জামি তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে যায়। তাই তাঁর কাছে এই দিনলিপির একটি অক্ষরও বাইরে থেকে ধার করতে হয়নি। কিন্তু শুধুমাত্র লিখে রাখাতেই জাহানারা থেমে যাননি। রাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঝলসে উঠেছিলেন জাহানারা। তাঁর নেতৃত্বেই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত, গণ আদালত গঠন, গণজাগরণের ডাক এসবই প্রত্যক্ষ করেছে নব্বই দশকের বাংলাদেশ। রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য জাহানারা সহ তাঁর অনুগামীদের বিভিন্ন মামলার মুখোমুখি পর্যন্ত হতে হয়। এসবের মাঝেই হঠাৎ মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন জাহানারা। তাঁর বাকশক্তি প্রায় ক্ষীণ হয়ে আসে। কিন্তু হেরে না যাওয়া এক লড়াইয়ের নাম জাহানারা। চিরকালের এক সংগ্রামের ইতিহাস আজীবন মনে রাখবে তাঁকে।
চিত্র ঋণ – বঙ্গদর্শন
Discussion about this post