“কফি হাউসের সেই আড্ডাটা” গাইতে গাইতে নস্টালজিক হতে বড়ই ভালোবাসেন সকলে। কিন্তু শুধুই আবেগে ভাসতে গিয়ে সেই নির্ভেজাল আড্ডাকে কোথাও হারিয়ে ফেলতে চলেছে না তো বাঙালি? সারা কলকাতা জুড়ে ক্যাফে-কালচার গড়ে ওঠা সত্ত্বেও, কফি হাউসের চরিত্র কোথাও যেন গিয়ে আলাদা হয়ে যায়। তা সে কলেজ স্ট্রিট হোক বা যাদবপুর কফি হাউস। নিয়মিত ও অনিয়মিত খদ্দের; তাঁদের আড্ডা, তর্ক, আলাপ, আলোচনার পরিসর সবটা নিয়েই যেন আজও কফি হাউস ধরে রেখেছে তার বৈশিষ্ট্য। সেই বৈশিষ্ট্যের উপরেই আঘাত এসে পড়েছে সম্প্রতি। আঘাত এসেছে যাদবপুর কফি হাউসের উপরে।
কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর ও চৌরঙ্গী- এই তিন জায়গার কফি হাউস নিয়েই মূলত গড়ে উঠেছিল বাঙালির আড্ডাখানা, সমস্ত চিন্তা-চেতনা-মননকে অনুশীলন করার অভ্যেস, সংস্কৃতি। তেমনই বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার, বিচিত্র মানুষের সমাগম যাদবপুর কফি হাউসে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝাঁ চকচকে, ওয়াইফাই ক্যাফেগুলির পাশে এই মানুষজনের জন্যই যাদবপুর কফি হাউস ধরে রাখতে পেরেছে তার অনন্যতা। এখানে যাদবপুর সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, প্রকাশক, বিজ্ঞানী, চিত্রপরিচালক, সঙ্গীতশিল্পী, গবেষক, কবি-সাহিত্যিক সকলেই আসেন। অনেকে আসেন বছরের পর বছর ধরে। আড্ডার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে কফির পেয়ালা হাতে নিজের মত পড়াশোনা করেন, লেখালেখি করেন, গবেষণার কাজ করেন। এমনটাই হয়ে এসেছে দশকের পর দশক। বর্তমানে কর্তৃপক্ষ নোটিস দিয়েছে যাদবপুর কফি হাউসে “ল্যাপটপ খোলা বা অন্যান্য কাজকর্ম” করা যাবেনা।
আচমকা এই ফতোয়াকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। যাদবপুর কফি হাউসের দীর্ঘদিনের খদ্দেররা মনে করছেন এটি কফি হাউসের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপর একটি বড়সড় আঘাত। তাঁদের মতে এই নোটিস সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বেআইনি, অনৈতিক, এবং অমানবিক। এই বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে তাঁরা ইতিমধ্যেই একটি অভিযোগ পত্র তৈরি করেছেন। অভিযোগ পত্রে কর্তৃপক্ষের কাছে ল্যাপটপ ব্যবহারের বিপক্ষে উপযুক্ত যুক্তিসহ, পুরুষ ও মহিলাদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা করা, খাবার পরিবেশনে ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং যথাযথ বিলিং সিস্টেম তৈরির কথা জানানো হয়েছে। এই চিঠি তাঁরা সমগ্র কফি হাউস কর্তৃপক্ষসহ, সমবায় সমিতি এবং কনজিউমার ফোরামে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
প্রতিবাদীদের একাংশ মনে করছেন, এর পিছনে অন্য কোনো ভয়াবহ পরিকল্পনা আছে। এক দীর্ঘদিনের খদ্দের বলছেন, “হয়তো এরপর বলবে বই নিয়ে আসা যাবে না। পড়াশোনা করা যাবে না। সমাজ, বিজ্ঞান, রাজনীতি কোনো আলোচনাই কফি হাউসে বসে করা যাবে না।” কেউ কেউ বলছেন, “যাঁরা দিনের পর দিন টেবিল দখল করে ব্যক্তিগত ব্যবসার কাজ করেন, তাঁদের আটকানো হচ্ছে না। কারণ তাঁরা ক্ষমতাশালী। উলটে আঘাত আসছে জনস্রোতের বিপরীতে থাকা মানুষের ওপরে।” বর্তমানে প্রতিবাদীরা আশা রাখছেন গণতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তাদের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে। এই বিষয়ে যাদবপুর কফি হাউসের ম্যানেজার অমিতবাবুর কাছে প্রতিক্রিয়া চাইলে তিনি জানান, “টেবিলে ল্যাপটপ এবং বইপত্র নিয়ে বসলে কাস্টমার উঠে যায়, আমাদের ব্যবসার ক্ষতি হয়। এছাড়া অনেকে লোনের ব্যবসা করছেন এখানে বসে, এগুলো এখানে সমস্যা তৈরি করছে।”
Discussion about this post