বীরভূম মানেই শুধু শান্তিনিকেতনে লংড্রাইভ বা দুদিনের শহুরে আমোদ-আহ্লাদ নয়। যুগে যুগে সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক বা ভ্রমণবিলাসীরা স্বীকার করবেন যে লাল-মাটি, শুষ্ক নদীপথের মধ্যেই, ইতিহাসে মোড়া বীরভূমের আসল লাবণ্য। অজয় বা ময়ূরাক্ষী নদীতীর ধরে এগোলেই চোখে পড়বে ঐতিহ্যমন্ডিত গ্রামগুলি। পুরনো ভাঙা মন্দিরের গায়ে স্থাপত্য বা কারুশিল্পের অমূল্য নিদর্শন। এসবের সঙ্গেই মিলবে অনেক অজানা গল্প, লোককথা, বিশ্বাস। তেমনি বহুমূল্য ঐতিহাসিক একটি স্থান হল বীরভূমের শিবপাহাড়ি।
ময়ূরাক্ষী নদীতীর থেকে রামপুরহাট তেঁতুলে গ্রামের সীমান্ত এবং মল্লারপুরের কাছে শিবপাহাড়ি থেকে ভাগীরথীর তীর পর্যন্ত এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল প্রাচীন একচক্রা নগরী। মহাভারত বর্ণিত সেই একচক্রা নগরী এখন শিবপাহাড়ি, বীরচন্দ্রপুর, ময়ূরেশ্বর, কোটাসুর প্রভৃতি গ্রামগুলিতে সীমাবদ্ধ। পাণ্ডবরা নাকি এই একচক্রা নগরীতে এসেছেন বারবার।
রামপুরহাট শহর থেকে এগিয়ে মল্লারপুর গ্রাম পেরোলেই শিবপাহাড়ি। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল ছিল অরণ্যসংকুল। এই অঞ্চলে পাণ্ডবদের বনবাসকালে কৌরবদের ভগ্নীপতি জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়েছিলেন। ভীমের হাতে অপমানিত হয়ে এই শিবপাহাড়িতে শিবের তপস্যা করেন জয়দ্রথ। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে বর দেন এবং সেই বরের ফলে জয়দ্রথ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একদিনের অজেয়তা লাভ করেন। সেই সুযোগে তিনি অর্জুন ও সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করেন। শোনা যায়, অনেক বছর পরে গুপ্তধনের সন্ধানে এই স্থান খুঁড়তে গিয়ে দৈববাণী শোনা গেছিল যে – “আমি জয়দ্রথ পূজিত দেব সিদ্ধিনাথ।“ তারপর খুঁজে পাওয়া যায় শিবলিঙ্গ এবং তার ওপরেই তৈরি মন্দির। আরো শোনা যায়, মহাভারতের সমসাময়িক এই শিবলিঙ্গটি কালাপাহাড়ের নজর থেকেও বাদ যায়নি।
বীরভূমের এই অঞ্চলের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভাও আপনার নজর কাড়তে বাধ্য। লাল মাটির ওপরে গাঢ় সবুজ জঙ্গল, জঙ্গলের মাঝে মাঝে টেরাকোটার প্রাচীন কারুকার্যের মন্দির। এই আভরণ, অলঙ্কারহীন সৌন্দর্যের সবটাই যেন কোন শিল্পীর হাতে আঁকা। এই সৌন্দর্যের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পৌরাণিক গল্প, ইতিহাসের প্রামাণিকতা এবং মানুষের বিচিত্র বিশ্বাস।
চিত্র ঋণ – সোহম ভট্টাচার্য্য
Discussion about this post