তামিলনাড়ুর কুরভাল গ্রামের এক অনন্য লোকাচারের কাহিনী মহাভারতে পাণ্ডবপুত্রদের কথা জিজ্ঞাসা করলে এক নিঃশ্বাসে সবাই বলে দেবেন অভিমন্যু আর ঘটোৎকচের নাম। কারুর কারুর মাথায় আসবে দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রদের কথাও। অন্যদিকে ইরাবান নামটা শুনলে অনেকেই মাথা চুলকাবেন। কারণ, অর্জুনের এই পুত্রটি আমাদের অনেকের কাছেই অপরিচিত। মহাভারতের সহজবোধ্য বাংলা সংস্করণ অথবা জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালগুলিতে তাঁর কথা তেমনভাবে উঠে আসেনি। কিন্তু, পাণ্ডবদের বিজয়ের নেপথ্যে ইরাবানের আত্মত্যাগ অভিমন্যু অথবা ঘটোৎকচের থেকে একচুলও কম নয়। অর্জুন আর নাগরাজ কন্যা উলুপীর ছেলে ইরাবান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়লাভ কামনা করে নিজেকে মাতৃমূর্তির সামনে বলি দিয়েছিলেন।
মৃত্যুর আগে তাঁর একমাত্র ইচ্ছে ছিল প্রথম এবং শেষবারের জন্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। কিন্তু, কোন মেয়ে মৃত্যুপথযাত্রী পুরুষের গলায় মালা তুলে দেবে! পাণ্ডবদের এহেন দুশ্চিন্তার ভার লাঘব করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। মোহিনী বেশে তিনি বন্ধুপুত্রের সাথে আবদ্ধ হয়েছিলেন বিয়ের বন্ধনে। দেবীমূর্তির সামনে ইরাবানের আত্মাহুতির পর রীতি মেনে বৈধব্যও পালন করেছিলেন তিনি। ইরাবান আর মোহিনীর এই কাহিনীর বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় নবম শতকে লেখা মহাভারতের তামিল সংস্করণটিতে।
মহাকাব্যিক আখ্যান ছাড়িয়ে ইরাবানের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। তাঁকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে লোকাচারের এক অনন্য ধারা। দক্ষিণভারতে ইরাবানের বেশ কয়েকটি মন্দির আছে। তার মধ্যে প্রধান মন্দিরটি রয়েছে তামিলনাড়ুর কুরভাল গ্রামে। প্রতি বছর সেখানে ইরাবানের স্মরণে আঠেরো দিন ধরে পালন করা হয় কুঠভাণ্ডার উৎসব। এই উৎসবে বিরাট গোঁফধারী ইরাবানের মুণ্ড মূর্তির মহাসমারোহে পুজো করা হয়। দেশের নানা প্রান্ত তো বটেই, প্রবাসী রূপান্তরকামীরাও জড়ো হন এই উৎসবে। এই দিনকটিতে তাঁরা প্রত্যেকেই হয়ে ওঠেন ইরাবানি বা আরাভানি অর্থাৎ ইরাবানের নিজস্ব রমণী। ইরাবানের প্রতিনিধি হিসেবে মন্দিরের পুরোহিত তাঁদের প্রত্যেকের মাথায় ঢেলে দেন সিঁদুর। আবার আঠেরো দিন পর ইরাবানের বিসর্জনের সাথে সাথে তাঁরা প্রত্যেকেই বৈধব্য বেশ ধারণ করেন। আসলে ইরাবান আর মোহিনীর পরিণয়ের মধ্যে সমপ্রেমী মানুষেরা তাঁদের সমপ্রেমের স্বীকৃতি দেখতে পান। আজকের দিনে যখন অতীত ঐতিহ্যের ধুয়ো তুলে বারবার সমপ্রেমের সম্পর্ককে আইনি স্বীকৃতি থেকে দূরে ঠেলে রাখা হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কাছে ততই যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন মহাভারতের গৌণ মুখ ইরাবান।
Discussion about this post