পর্ব – ২
প্রশ্ন: নতুন শিল্পী বা যারা খুব একটা জনপ্রিয় নন, তাদের শোয়ের সময় নিয়ে, পেমেন্ট দেওয়া নিয়ে অনেক সমস্যা হয়, আবার অনেক সময় শেষ মুহূর্তে শো ক্যান্সেলের মত ঘটনাও ঘটে। এটা নিয়ে আপনার কি মত?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: এটা অবশ্যই একটা বিরাট বড় সমস্যা। তবে, এই সমস্যার মূল কারণটা একটু আলাদা। সাধারণভাবে দেখতে গেলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেও খুব একটা ভালো নয়। আগের তুলনায় এখন অনেকটাই পড়েছে বাংলার স্থান। তার উপর আরো বড় সমস্যা হলো, বিনোদনের খাতে বাংলায় আর্থিক বিনিয়োগের পরিমাণ একেবারেই তুচ্ছ। আর এর সবথেকে বড় ভুক্তভোগী হলেন নাটকের শিল্পীরা। তাদেরকে যে টাকা দেওয়া হয় সেটা হয়তো একেবারেই নগণ্য। তবুও তাদেরকে পেটের দায়ে কাজটা করে যেতে হয়।
আর এর পাশাপাশি, আমাদের দেশের আরেকটা সমস্যা হলো শিল্পীর অসম্মান। ভারতে শিল্পীকে কখনোই যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়না। এখানে একটা জমিদারি কালচার চলে। যেন টাকা দিয়েছি মানে তাকে একেবারে ভাড়া করে নিয়েছি। পুরোদস্তুর, মুখের উপর টাকা ছুঁড়ে দিয়ে মজা দেখার মতো একটা ব্যাপার। কিন্তু বিদেশে ব্যাপারটা এরকম নয়। পড়াশোনার সূত্রে বিদেশে ৫ বছর থাকার সুবাদে আমার বিদেশের কালচারের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় আছে। কলেজ স্টুডেন্ট হিসাবে নিজের খরচ চালানোর জন্য আমি সে সময় একটা পাবে গানও করতাম, তারা আমাকে পেমেন্টও করতেন নিয়ম করে। সেখানে ছোট করার কোনো বিষয় নেই। সেদেশে একজন ডাক্তার যেমনভাবে নিজের টাকা ও সম্মান পাচ্ছেন, তেমনভাবেই একজন শিল্পীও টাকা আর সম্মান পাচ্ছেন। কিন্তু, আমাদের দেশে একজন শিল্পীকে ভাড়া করছি, আর একজন ডাক্তারকে ফোন করছি, দুটো কথার মধ্যে অনেক তফাৎ। এই দুটোকে একভাবে গ্রহণ করার মতো সংবেদনশীল ও শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা দুঃখজনকভাবে ভারতে দিন প্রতিদিন কমছে, ভবিষ্যতে হয়তো এই মানুষগুলো আরোই বিরল হয়ে উঠবেন।
প্রশ্ন: বাংলার শিল্পের এই ফ্যাসিস্ট মানসিকতার সঙ্গে লড়াইয়ে কাছের মানুষদের কতটা পাশে পেয়েছেন?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: কাছের মানুষদের বলতে গেলে, যাদের আমি সত্যিকারের কাছের মানুষ হিসেবে মনে করি, আমার পরিবার, আমার প্রেমিকা, আমার ছাত্রছাত্রীরা, আমার সহকর্মীরা, তাদের সবসময় আমার পাশে পেয়েছি আর সেটার কারণেই হয়তো আমি এতটা পথ এগোতে পেরেছি। বিগত কয়েকটা বছরে আমার যে মানসিক চাপানউতরের সময়টা চলছিল, সেই সময় এই মানুষগুলোই আমাকে সবসময় সাহস জুগিয়েছেন।
অন্যদিকে, যেটাকে এই ‘ফ্যাসিস্ট মানসিকতা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেটার আরও কিছু দিক রয়েছে। আমাদের দেশে বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের শিল্পের জগতে লবি জিনিসটা ভীষণ প্রভাবশালী। ফলে, যদি কোনো শিল্পী এই লবির অংশ হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে হয়তো তিনি কয়েকটা বেশি শো পাবেন। আবার, যদি কোনো শিল্পী এই ফ্যাসিস্ট লবির অংশ হতে না চান, তাহলে তার শো ক্যানসেল হবে। আবার কোনো কোনো শিল্পী এমন রয়েছেন, যারা এই ফ্যাসিস্ট বিষয়টাকে ফ্যাসিস্ট বলে প্রকাশ্যে দাবি করেই জনপ্রিয় হয়েছেন, কিন্তু তার থেকে বেশি কিছু করতে চাইছেন না। ফলে এই গোষ্ঠীদের থেকে খুব একটা বেশি সাহায্য পাইনি কখনও, আর কোনোদিন আশাও রাখিনা সাহায্যের। আমি নিজের কাছের মানুষদের বৃত্তটাকে খুবই ছোটর মধ্যে রাখি। তাদেরকে নিয়েই আমার সময় কেটে যায়।
প্রশ্ন: বাংলা ব্যান্ডের গানে পলিটিক্স, এই বিষয়টা নিয়ে আপনার কি মত?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: ভালো কাজ যে একেবারেই হচ্ছেনা, সেরকম না। আমি মনে করি, বাংলার শিল্পের সবকিছু খারাপ নয়, ভালো কাজ অবশ্যই হচ্ছে। আমি যখন বিদেশ থেকে পিএইচডি করে ফিরছি, তখন অনেক বার শুনতে হয়েছিল, বিদেশে তো একটা ভালো অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে যেতে, দেশে কেন ফিরছো, এখানে তো শুধুই পলিটিক্স আর পলিটিক্স। আমি সোচ্চারভাবে এই বিষয়টার বিরোধিতা করি, যে বাংলায় শুধুমাত্র পলিটিক্স রয়েছে। রাজনীতি ছাড়াও বাংলাতে অনেক ভালো কাজ হয়। বিশেষত, মফস্বলের দিকের তরুণ-তরুণীরা, যারা গানের জগতে আসতে চাইছেন তারা প্রাণপণ লড়াই করছেন নিজের জায়গা তৈরি করার জন্য। ছোট ছোট ব্যান্ড তৈরি করে গানবাজনা করছেন। ফলে, কাজ একেবারেই হচ্ছে না তেমনটা নয়।
তবে হ্যাঁ, ঘুরে ফিরে বিষয়টা সেই অর্থনীতিকেন্দ্রিক। যদি রিসোর্স একই থাকে এবং জনসংখ্যা বেড়ে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত দুজন মানুষ একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে বাধ্য, কারণ দুজনেরই একই জিনিসের দরকার। আর সেটাই এখন হচ্ছে। একটা সময় আমি কিছু মানুষকে ভেবেছিলাম, তারা হয়তো রাজনীতি থেকে সরে এসে একটা সুস্থ শিল্পী সমাজ গড়ে তুলতে চাইছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা রাজনীতিতে যোগদান করলেন। তখন হয়তো তাদের প্রতি আমার সম্মানটা চলে গেছে, কিন্তু বাংলায় শুধুমাত্র রাজনীতিই হচ্ছে, আর কোনো কাজ হচ্ছেনা, সেই ধারণার তীব্র বিরোধিতা করি। তবে হ্যাঁ, এই রাজনীতিকে যদি আমরা পুরোপুরি দূর করতে চাই, তাহলে সবার আগে আমাদের অর্থনীতিকে ঠিক করতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতেও এই সমস্যা, এই খেয়ো-খেয়ি চলতেই থাকবে।
Discussion about this post