এক যে আছে মেয়ে, আর আছে তার ‘ধনুক ভাঙা পণ’। এখানে অবশ্য ধনুক ভাঙতে মেয়েটার স্বপ্নে ছেদ পড়ে, কিন্তু লক্ষ্যে সে এখনও অবিচল। মাথা ভর্তি ঋণের বোঝা আর সেই ভাঙা ধনুক কী করে জুড়বে সেই চিন্তা নিয়েই মেয়েটা লড়ে চলেছে। সে জানে, একবার সেই ভাঙা ধনুক জুড়ে গেলে তাকে আর কেউ দমিয়ে রাখতে পারবেনা। সেই মেয়ে আন্তর্জাতিক তীরন্দাজি প্রতিযোগিতায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার পর এখন চালাচ্ছে চায়ের দোকান। কেন? কে এই মেয়ে? চলুন তবে গোড়া থেকে শুরু করা যাক।
ঝাড়খন্ডের এক দরিদ্র আদিবাসী পরিবারের মেয়ে দীপ্তি কুমারী। বাবা- মা দিনমজুরের কাজ করে। ছোটো থেকেই তীর-ধনুকের প্রতি আগ্রহ দীপ্তির। তার তখন মাত্র চোদ্দ বছর বয়স, বাবার বানিয়ে দেওয়া বাঁশের ধনুককে হাতিয়ার করেই দীপ্তি নেমে পড়ে স্কুল স্তরের আর্চারি প্রতিযোগীতায়। সেখানে চ্যাম্পিয়নও হয় দীপ্তি। তারপর এলো রাজ্যস্তরের প্রতিযোগীতা। কিন্তু রাজ্যস্তরে তো বাঁশের ধনুক চলেনা। তখন দীপ্তির দিনমজুর মা দেড় লক্ষ টাকা ধার করে কিনে দিলেন প্রতিযোগীতার উপযুক্ত ধনুক। তারপর একের পর এক মেডেল ও কোনো ব্যক্তিগত কোচ ছাড়াই রেকর্ড সময়ে জাতীয় স্তরে পৌঁছে তাক লাগিয়ে দেয় দীপ্তি। প্রশিক্ষণের জন্য দীপ্তি ডাক পায় ঝাড়খন্ডের বীরসা মুন্ডা আর্চারি অ্যাকাডেমিতে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে দীপ্তি জিতে নেয় সোনার মেডেল।
২০১২-র আন্তর্জাতিক আর্চারি প্রতিযোগীতায় নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করে দীপ্তি। কিন্তু আবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক মানের ধনুক, বাধ সাধে দারিদ্র।আবার হার না মানা লড়াইয়ে সামিল হয় দীপ্তির মা। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী থেকে ধার করেন সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা, দীপ্তিকে কিনে দেন আন্তর্জাতিক মানের ধনুক। প্রতিযোগিতায় আমন্ত্রিত হয়ে সে আমেরিকায় পাড়ি জমায়। ঠিক সেইসময় মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল। প্রতিযোগিতার মাঝেই ভেঙে যায় দীপ্তির নতুন ধনুক, সঙ্গে ভাঙে বুকে ভেতর তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন। প্রতিযোগিতাই যখন ধনুকের তখন ভাঙা ধনুক এমনিই কেড়ে নিল তার সুযোগ। নিরূপায় হয়ে ভাঙা মন, ভাঙা ধনুক নিয়ে ফিরে আসে দীপ্তি।
পুরোনো ঋণের বোঝায় এমনিতেই জর্জরিত তার পরিবার। তারমধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয় মা সীতাদেবী, বোনের সেলস্-এর চাকরিও চলে যায়, রিক্সাচালক দাদার রোজগার সামান্য। সবমিলিয়ে দীপ্তি আর তার পরিবারের টালমাটাল অবস্থা।যোদ্ধা মাত্রই তো লড়াকু, দীপ্তিও তাই। তার স্বপ্নের লড়াইয়ে ছেদ পড়ল তবু জীবনের লড়াই ছেড়ে তো আর পালানো যায়না। বন্ধুর থেকে ৬০,০০০ টাকা ধার করে রাঁচির আরগোরা চকে একটা ছোট্ট ঠেলায় দীপ্তি চালু করেছে চায়ের দোকান। বছর ২৫-এর দীপ্তি চা, সিঙ্গারা বেচতে গিয়েও তার স্বপ্নের কথা ভোলেনি। সহানুভূতি নয়, সে শুধু চায় একটা ধনুক। তাহলেই সে আবার প্রমাণ করবে নিজেকে। নানা সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সাহায্যের চেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি। প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ হিসাবে ঝাড়খন্ড পুলিশে কনস্টেবলের চাকরির আশ্বাস পেলেও, সে চাকরি আজও পায়নি দীপ্তি। আমাদের দেশের এমন অনেক প্রতিভা হারিয়ে যায় শুধু দারিদ্রের অন্ধকারে। একজন খেলোয়াড় দেশের প্রতিনিধিত্ব করে জিতলে যদি তার জয় আর দেশের জয় এক হয়। তাহলে তার জীবনের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া কি দেশের হেরে যাওয়া নয়? আবার কোনোদিন দীপ্তি জিতে গেলে তার জয়ের ভাগ গোটা দেশ নেবে, কিন্তু তার লড়াইয়ের ভাগ কেউ নেয়নি। এখন লড়াইয়ের ময়দানে দীপ্তি একা।
তথ্য ঋণ – আশাভরী
Discussion about this post