“জাতির এক কালো অধ্যায় একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে স্বাধীনতার ঠিক পূর্বক্ষণে ঘাতকরা বেছে বেছে হত্যা করে”। জানা গিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪৯ জন ছিল ঢাকায়। রংপুরে মারা যায় ৭২ জন, যশোরে ৯১, দিনাজপুরে ৬১, খুলনায় ৬৫, পাবনায় ৫৩, ময়মনসিংহে ৭৫, বরিশালে ৭৫, রাজশাহীতে ৫৪, চট্টগ্রামে ৬২, কুমিল্লায় ৮৬ এবং ফরিদপুরে ৪৩ জন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর চালিয়েছিল গণহত্যা। গণহত্যার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তমনা কয়েকশো মানুষকে হত্যা করেছে পাক বাহিনী এবং তাদের সশস্ত্র সহযোগী রাজাকার-আলবদর ও আল শামস বাহিনী।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেছে বেছে ধরে নিয়ে আসা হয় সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ জ্ঞানী-প্রতিভাশালী মানুষদের। এরপর নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়। ঢাকার মিরপুর, রাজারবাগ, মোহাম্মাদপুর, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, লালখান বাজার, স্টেশন-কলোনীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের পচা-গলা মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহগুলোতে ছিল অকল্পনীয় নির্যাতনের চিহ্ন। অনেক বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। এর লক্ষ্য ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করা। স্বাধীনতা পাওয়ার পরেও বাঙালি জাতি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে – এটাই ছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার হীন উদ্দেশ্য।
১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বুদ্ধিজীবীহত্যার স্মরণে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ স্থাপনসহ অনেক কর্মসূচি রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরেও জেলাগুলোতেও অনেক বুদ্ধিজীবীদের এই সময় হত্যা করা হয় কিন্তু তাদেরকে সেভাবে স্মরণ করা হয় না। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সব মানুষের অবদান রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র আর প্রান্তিকের সমস্যার কারণে প্রায় সমস্ত মানুষ বাকি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করার কথা ভুলেই গেছেন। শুধুমাত্র স্মরণ করার ক্ষেত্রেই নয় স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরের হাজার হাজার মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই সময় তাদের গ্রামের যেসব মানুষ আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদেরও ভূমিকা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু তাদেরকেও স্মরণ করা হয় না। এর কারণ তাদের নাম কোনোদিন সামনেই আসেনি। এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করছিলেন কিন্তু তাঁদের কথা জনসমক্ষে আসেনি। স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে। তারা সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার উদ্যোগ নিলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
Discussion about this post