ইতিহাসের পাতা জুড়ে লেগে থাকে অদৃশ্য রক্তের দাগ। পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ আকার নেয় বিদ্রোহের। অতীতে ঘটে আসা নানান বিদ্রোহের মধ্যে নীল বিদ্রোহ শোষণের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত। আর এ বিদ্রোহের আগুন ছুঁয়ে গিয়েছে তৎকালীন বগুলা আর শ্যামনগরকে। এই এলাকা তখন বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। তাই বলা চলে, অত্যাচার কোনো কাঁটাতার মানে না।
সে সময়ে শ্যামনগরে অন্যতম গ্রাম প্রধান কাল্লু মণ্ডল। গোম্সতাদের আদেশ ছিল, নীল চাষের জমি নিড়ণ না করে চাষ করা যাবে না। কাল্লু মণ্ডল এ আদেশ একেবারেই মানেনি ওই মুহূর্তে। ব্যস, অত্যাচার সীমা পেরিয়ে গেল। কাল্লু মণ্ডলের বাড়িতে হাজির সড়কিওয়ালা। তাঁকে নির্মমভাবে মারতে মারতে নিয়ে আসে গোরাগাঙনি নদীর পাড়ের বগুলার নীলকুঠিতে। ঠিক এইসময় আর একজন বৃদ্ধ চাষী মজ্জুদ্দিন নিজের বাড়িতে বসে কাজ করিছিলেন। লেঠেলরা অন্যায়ভাবে তাঁকেও বেদম পেটাতে শুরু করে। পিঠমোড়া করে বেঁধে বগুলার নীলকুঠিতে এনে ফেলে। এইসময় মজ্জুদ্দিনের ভাইপো গাঁয়ের অন্য চাষীদের কাছে খবরটা পৌঁছে দেয়। চাষীরা সমবেতভাবে গ্রামের পথেই তাগিদদার ও লেঠেলদের ঘিরে ধরে।
এমনকি বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে সে সময়ের লেনদেনের কথা। ক্লোসওয়ার্থি গ্র্যান্ট- এর রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল নামের গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে ১৯৬০ সালের কথা। যেখানে বলা হয়েছে, ফারলঙ্ ও লালমুরের ‘বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানি’-র জমিদারীভুক্ত ছিল প্রায় পাঁচশো পঁচানব্বই (৫৯৫) টি গ্রাম। আর এই বিরাট সম্পত্তির জন্য তাঁরা খাজনা দিতেন তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার (৩,৪০,০০০.০০) টাকা। অন্যদিকে, কোম্পানির ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদের মূল্য ছিল পঞ্চাশ লক্ষ (৫০,০০,০০০.০০) টাকা। কেবলমাত্র নদীয়া জেলাতেই নীলের ব্যবসাতে তাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন আঠারো লক্ষ (১৮,০০,০০০.০০) টাকা। আর এ থেকে বোঝাই যায় এ টাকার অঙ্ক তৎকালীন সময়ে একেবারেই কম নয়।
‘সংবাদ প্রভাকর’-এর বয়ান অনুযায়ী “সড়কিওয়ালা এবং তাগিদদারকে প্রহার করিয়া একস্থানে বদ্ধ করিয়া রাখিল, এবং দুইজন প্রজাকে মুক্তিদান করিল।” এভাবেই বাংলাদেশের নীলবিদ্রোহের প্রথম সূত্রপাত হয় ১৮৫৮ সালে, বগুলার নীলকুঠিতে। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মত। অন্যদিকে, প্রজাদের কোনো উপায় নেই। তারা জানে নীলকুঠিতে তাদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার হবে। ইতিমধ্যে চূর্ণী নদীর তীরের এক নীলকুঠিতে শুরু হয়েছে নীলকর সাহেবদের নিজস্ব বিচারের নামে প্রহসন। যা নাকি প্রজার উপর শাস্তিবিধান! এ খবর গাঁয়ে গাঁয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ফলে প্রজারা বগুলার নীলকুঠিতে যায়নি।
নীল কর সাহেবদের অত্যাচারের কথা পাতায় পাতায় বর্ণিত। লাঠির বাড়ি থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছে নীল চাষিদের। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘সংবাদ প্রভাকর’ সহ বিভিন্ন পত্রিকায় বারবারই উঠে এসেছে নীল চাষিদের ঠকে যাওয়া জীবনের কথা। তবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষকে তো ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। আর তাই ইতিহাসে ঘটে গেছে নীল বিদ্রোহ। নীল কর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠার কাহিনী। এই বিদ্রোহের সক্রিয় ভূমিকা শুরু হয় ১৮৫৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বগুলা-শ্যামনগরের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮৫৮ সালের গোড়ায়। আর এ বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বিস্তৃত ছিল প্রায় দিগন্ত পর্যন্ত। কারণ গ্রামের পর গ্রাম ছিল নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের শিকার। এ শিখা আজও সমান তেজে জ্বলছে ভারতের ইতিহাসে।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – পিনাক পাণি
Discussion about this post