চলতি বছরের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভয়ানক এক দস্যু-ঝড়, আমফান। আমফানের দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারা রাজ্যই। সে ক্ষতি এখনও পূরণ করা যায়নি। তবে সবথেকে বেশি ক্ষতি স্বীকার করেছে রাজ্যের ব-দ্বীপ অঞ্চল সুন্দরবন। ঝড়ের ভয়াবহ তান্ডবলীলায় সারা সুন্দরবন অঞ্চলই প্রায় তছনছ হয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতিতে প্রলেপ লাগানোর কাজ চলছে এখনও। তবে সুন্দরবন বলতেই প্রথমে যা মাথায় আসে তা হল, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তাহলে কি আমফানের ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় নাম উঠেছে তারও? নাহ! সেই আশঙ্কার কারণ এখন একদমই নেই। বর্তমানের শত ক্ষতির মধ্যেও কিছুটা স্বস্তির আশ্বাস দিল এই সুন্দরবন। আমফানের পরও সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা মারা যায়নি একটি বাঘ। এমনকি চলতি বছরে বেড়েছে তাদের বৃদ্ধির হারও।
বাস্তুতন্ত্রের একটি প্রচলিত কথা হল, যে জঙ্গলে বাঘ জীবিত এবং সমৃদ্ধ থাকতে পারে, তা সুস্থ এক বাস্তুতন্ত্র বাসস্থানের লক্ষণ। বর্তমানে বাঘের প্রাকৃতিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রায় অনেকটাই এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন৷ আমফান ঝড়ের পর সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সুস্থ বাসস্থান সম্পর্কে তাই কিছুটা অনিশ্চিত এবং উদ্বিগ্নই ছিল বনদপ্তর বিভাগ৷ তবে আশার আলো এই যে, বাঘের বিন্দুমাত্র ক্ষতিও করতে পারেনি এই ঝড়৷ আমফানের পর ট্র্যাঙ্কুলাইজার বন্দুক, জাল এবং স্পিড বোট নিয়ে বনদপ্তরের একটি দল বাঘের সুরক্ষায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সজনেখালী এবং ঝাড়খালি অঞ্চলে খোঁজ-খবর চালায়। তখনই নিশ্চিত করা হয় বাঘগুলি জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে, মানব বসতিতে প্রবেশ করেনি। ফলে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ খুবই কম। এমনকি সারা ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য দুটি কন্ট্রোল রুমও স্থাপিত হয়। মানব বসতিতে বাঘের প্রবেশ আটকাতে জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল বনাঞ্চল। ঝড়ে সেই জালের কিছুটা ক্ষতি হলেও বাঘের কোনও ক্ষতি হয়নি। এমনকি এই ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলি সারাতে গিয়ে নদীতে একটি বিশাল বড় বাঘকে সাঁতার কাটতেও দেখে বনদপ্তর বিভাগ। তখনই মেলে স্বস্তির নিশ্বাস। এ প্রসঙ্গে বনদপ্তর বিভাগের মুখ্য ওয়ার্ডেন রবিকান্ত সিনহা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় মূল বনাঞ্চল বা আশেপাশের গ্রামে কোনও রকম বন্যপ্রাণী বিশেষতঃ বাঘের হতাহতের কোনও রকম খবর এখনও অবধি পাওয়া যায়নি।
বিশ্বের মধ্যে বাঘের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে এখনও অবধি সবথেকে বেশি পশ্চিমবঙ্গের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা৷ তবে বর্তমানে বাঘের আটটি উপপ্রজাতির মধ্যে তিনটিই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বাকি প্রজাতিও প্রায় বিপন্নের তালিকায়। গবেষকদের মতে ২০৭০ সালের মধ্যেই সুন্দরবনে বাঘের সমস্ত প্রজাতিই বিলুপ্তির পথে হাঁটবে৷ সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতেই সঠিক পদ্ধতিতে বাঘ সংরক্ষণ প্রয়োজন। বর্তমানে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঘেদের বাসস্থানও। তবে আশার কথা এই যে সংরক্ষণের বিভাগগুলিকে আরও উন্নত করতে রাজ্যের বনদপ্তর বিভাগ নিয়মিত চেষ্টা চালাচ্ছে। বাঘের বাসস্থান এবং খাদ্য সংরক্ষণের দিকেও বিশেষ নজর দিয়েছে তারা। এমনকি রাজ্য সরকারও এই বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর। তাই সুন্দরবনে বাড়ছে বাঘের বৃদ্ধির হারও। আশা করা যায় ভবিষ্যতেও একই ভাবে বাড়বে বাঘের উপপ্রজাতির সংখ্যা। বিলুপ্ত কোনও প্রজাতি নয় বরং বৃহত্তম প্রজাতি হিসেবেই সারা পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করুক সুন্দরবনের এই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
Discussion about this post