দুর্গা পুজো শুধু একটা উৎসব নয়। একটা জাতির পরিচয়। একটা জাতির মনন। একটা জাতির ঐতিহ্য। বাঙালি জীবনের অহঙ্কারের সঙ্গে জুড়ে আছে শারদ উৎসব। সারা বিশ্বের দরবারে এই উৎসব বাঙালির পরিচয় বহন করে। শশীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কলমেও আজ থেকে বহু বছর আগের বঙ্গ জীবনের দুর্গাপুজোর যে চিত্র গ্রাম্য জীবনেও পাওয়া যায় তাতে আনন্দ উৎসবের মাহাত্ম্যই বিশেষ ভাবে উপস্থাপিত হয়। তিনি সরসভাবে উল্লেখ করেছেন,“ প্রতিমায় যখন মাটি দেওয়া হইত, তখন হইতে ছেলেদের মনে পরম আনন্দ। পাঠশালা হইতে কোন গতিকে পাঠ শেষ করিয়াই আমরা পুজা বাড়ি প্রতিমা গঠন দেখিয়ে যাইতাম। যখন ঠাকুরের গায়ে রং, গর্জ্জন তেল, মুখ বসান এবং চক্ষুদান হইত, তখন আমাদের ছেলের দলের আনন্দ দেখে কে? জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের ছেলেরা এই মহানন্দে যোগ দিত। যখন প্রতিমার সাজসজ্জা হইত , তখন ছেলের দল পূজা বাড়িতেই বসিয়া থাকিত।”
কাজেই বোঝা যাচ্ছে বাংলার বুকে হয়ত তখন থিম পুজো, প্রতিযোগিতা না থাকলেও আবেগ জুড়ে ছিল ষোল আনা। আজ যেমন রইল হাওড়া জেলার এক বাড়ির পুজোর কথা। হাওড়া জেলার আন্দুল বাজার বাসস্টপের কাছ থেকে কিছুটা দূরেই কুণ্ডু চৌধুরীদের বিশাল জমিদার বাড়ী। জায়গাটার নাম মহিয়ারী। বেশ বড় পুজো এদের কিন্তু বিশেষ করে যেটা বলার, তা হল, এটা বাংলার সেইরকমই মাত্র গুটি কয়েক বাড়ীর একটি, যেখানে বছরে দুবার দুর্গা পুজো হয় – একবার চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজো, অন্যটি এই শরৎকালের শারদীয়া অকাল বোধন। এদের পুজোর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত এখানে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিতা হন না। দেবী যুদ্ধরত নন। তাই অসুর, মোষ, সিংহ কিছুই নেই এখানে। এখানে দেবীর সম্পূর্ণ এক পারিবারিক রূপ। পুত্র কন্যা স্বামীর সঙ্গে মিলে সেই প্রতিমা হরগৌরীর। ষাঁড়ের পিঠে বসে আছেন শিব, তাঁর পাশেই মা দুর্গা অত্যন্ত শান্ত রূপে, তাঁদের ঘিরে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশ – এক নিটোল পারিবারিক ছবি। বাসন্তী পুজো আর শারদীয়া – দুটে ক্ষেত্রেই মায়ের একই মূর্তি। দুটো ক্ষেত্রেই পুজো কিন্তু হয় একই কাঠামোর ওপরে, আর সেই কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথের দিন। এঁদের গৃহ দেবতা লক্ষ্মী জনার্দন, সারা বছর বাড়ীতে তিনি নিত্য পূজিতা হন। ফলে এখানে পুজোও হয় বৈষ্ণব মতে। পুজোর কয়েকদিন আমিষের কোন ভূমিকা থাকে না। একমাত্র দশমীর দিন বিসর্জনের উদ্দেশ্যে মাকে ঠাকুরদালান থেকে উঠোনে নামানোর পরেই মাছ খাওয়া যেতে পারে।
এদের পুজোর আরো একটি বৈশিষ্ট – হরগৌরীর পাশাপাশি এখানে গরুড়ের পুজোও হয়। গরুড় এখানে অধিষ্ঠান করেন – পাশেই একটি রূপোর সিংহাসনে, পুজোর সামগ্রীও সব রূপোর। এইভাবে আলাদা করে গরুড়ের পুজোও বোধহয় বেশ বিরল। পুরনো প্রথা অনুযায়ী এখনও দুর্গা পুজোর সময়ে নৌকো পুজোও করা হয়। অষ্টমী পুজোর দিন ধুনো পোড়ানোয় বাড়ীর সব গৃহিণীরা অংশগ্রহণ করেন। আগে প্রায় ৯৬ মন চাল ঝাড়াই বাছাই করে বিশাল নৈবেদ্যর ব্যবস্থা করা হত। এখন তা অবশ্য নেমে কুড়ি কিলোয় দাঁড়িয়েছে। ঠিক তেমনই আগে বিসর্জন হত পাশেই বহমান সরস্বতী নদীতে। এখন তা মজে যাওয়ায় বর্তমানে বিসর্জন হয় গঙ্গাতেই। প্রথা আচার অনুষ্ঠান ভিন্ন রূপে হলেও বাঙালি তাঁর জগৎখ্যাত মায়ের আগমনকে ঘিরে চরম আবেগের বহিঃ প্রকাশে উন্মাদনার শিখরে পৌঁছে যায়। সেটাই বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। বারো মাসের তেরো পার্বণ তো আছে। কিন্তু এই এক পার্বণই আমাদের বঙ্গ জীবনের উচ্ছ্বাসের অপর নাম।
Discussion about this post