কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীর প্রাক্কালে তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা বলা মানেই আকাশ পাতাল এক করা! বিস্ময় পুরুষের বোধের গোচরে বোধহয় তৎকালীন বসুন্ধরার এমন কোনো বিষয় ছিল না যা এই মহামানবের নজর এড়িয়েছে। সাহিত্যের সঙ্গে সুরের সাধনা, চিত্রশিল্প, নাটক, দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান এমন কী অলৌকিক বিষয়ও ছিল বিশ্ব বরেণ্য নোবেল জয়ী ব্যক্তিত্বের চারণ ভূমি। কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, মানব দরদী বিশ্ব বরেণ্য রবি ঠাকুর চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছিলেন। শুধু পড়াশোনাই নয়, রীতিমতো প্র্যাকটিস করেছিলেন। তাঁর ডাক্তারি নিজের ওপর যেমন চালিয়েছিলেন, করেছিলেন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদেরও চিকিৎসা।
প্রথার বাইরে হেঁটে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন প্রকৃতির মাঝে ছক ভাঙা শিক্ষা ব্যবস্থা। শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল তাঁর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়ে অনুসন্ধান, পড়াশোনা ও ব্যবহার। চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি সিংহভাগ কবির মন দখল করলেও, পরবর্তী সময়ে বায়োকেমিক ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসাও রবীন্দ্রনাথের চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। কন্যা মীরা দেবীর ছেলের একজিমা রোগের জন্য চিঠি মারফত সালফার ২০০’র দুটো করে বড়ি খাওয়ানোর পরামর্শ দেন রবীন্দ্রনাথ। মানসিক অবসাদ কাটাতে বায়োকেমিক ওষুধ কালী ফস ৬x যে দুর্দান্ত ভাবে কবিকে উপকৃত করছে তা হেমন্তবালা দেবীকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট
।
আয়ুর্বেদেও আস্থা কম ছিল না রবীন্দ্রনাথের। পড়েছিলেন চরক সংহিতা। শিবনাথ শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে বাঁধা ছিল তাঁর নিয়মিত চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা। রবীন্দ্র-ইতিহাস বলে, ছোটবেলায় তৎকালীন ক্যাম্বেল হাসপাতালের ছাত্রের কাছে রবীন্দ্রনাথ শিখতেন অস্থিবিদ্যা। জোড়া লাগিয়ে গড়ে তুলতে পারতেন আস্ত একটা কঙ্কাল। চিকিৎসা পদ্ধতির বিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা সাম্রাজ্য বিস্তার করলেও রবীন্দ্রনাথের সমীহ আদায় করতে পারেনি। সর্বশেষ বিকল্প হিসেবেই তিনি অ্যালোপ্যাথিকে গণ্য করতেন। শল্য চিকিৎসাকে অসম্ভব অপছন্দ করতেন তিনি। যদিও শেষমেশ অর্শ চিকিৎসার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ১৯১২ সালে আমেরিকার ডাচেস নার্সিংহোমে করাতে হয়েছিল অপারেশন।
জীবনের বেশির ভাগটাই রবীন্দ্রনাথ অনুশাসনে বেঁধেছিলেন নিজের শরীর ও মনকে। উপহারে পেয়েছিলেন রোগ-ব্যাধি মুক্ত জীবন। সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বরে চলতো স্ব-প্রস্তাবিত হোমিওপ্যাথি ওষুধ। বিজ্ঞানের সাধক রবীন্দ্রনাথের স্ববিরোধিতা নিয়ে সমালোচকদের একাংশ প্রশ্ন তোলেন আকছার। আধুনিক বিজ্ঞানের তর্কের মুখে হোমিওপ্যাথি-বায়োকেমিক ও আয়ুর্বেদের তত্ত্ব বারংবার হারিয়েছে যুক্তি। রবীন্দ্রনাথের হোমিও-প্রীতির পক্ষে বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য, কবিগুরু বিজ্ঞানকে সত্য অবধি পৌঁছোনোর কিছু সিঁড়ি মনে করতেন, সত্য নয়। বিজ্ঞানের আওতার বাইরে যে সত্য আছে, তা একমাত্র অনুভবেই ছোঁয়া যায়, মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। তবে শেষ বয়সে এসে হোমিওপ্যাথির সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বারোটি লবণের ভিন্ন অনুপাত যোগে সৃষ্ট বায়োকেমিক ওষুধের দিকে ঝুঁকেছিলেন কবি। বিলিয়ে দিয়েছিলেন হোমিওপ্যাথির সব কটা বই।
Discussion about this post