ট্রেন ছুটে চলেছে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠটার মধ্য দিয়ে। দগদগে গরম বাষ্পটা হুহু করে বেরোচ্ছে তার মাথাটা দিয়ে। আর অপু দুর্গা কাশবনে দাঁড়িয়ে ছুটন্ত ট্রেনের সেই দৃশ্যটি পরম তৃপ্তিতে উপভোগ করছে। কি চোখের সামনে ভাসছে তো ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার এই জনপ্রিয় অংশটি? ভাসারই কথা। বাঙালির আবেগের সাথে যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে পুরোনো দিনের এইসব স্মৃতির অংশ। পুরোনো বাড়ি পুরোনো গল্প কিংবা পুরোনো সাহিত্য আজও আমাদের কাছে ঐতিহ্যের শরিক হয়েই রয়েছে। আর সেইসব কিংবদন্তী সাহিত্যস্রষ্টার রক্ত মাংসের শরীরটা আজ না থাকলেও, জীবিত রয়েছে তাঁদের সৃষ্টি। নিঃশব্দে আজও শ্বাস নিয়ে চলে হাজার পুঁথির সেই কল্পকথা। তেমনই এক কথাসাহিত্যিক হলেন বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর লেখা উপন্যাস আজও বইপ্রেমী মানুষদের মনে শিহরণ সঞ্চার করে। জাগায় নতুন আশা নতুন স্বপ্ন, বাঁচিয়ে রাখে আমাদের কল্পশক্তির চিন্তাগুলোকে। কিন্তু শতশত স্মৃতিঘেরা তাঁর সাধের বাড়ি তার কী হবে? তাকে কি আর বাঁচনো সম্ভব?
বিভূতিভূষণ বাবুর পুত্রবধূ মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় উগড়ে দেন ক্ষোভ। ব্যারাকপুর স্টেশনের কাছে সুকান্ত সদনের পেছনেই বিভূতিবাবুর বাসভূমি। তাঁর ভালোবাসার ‘আরণ্যক’। অভিযোগ সেই বাড়ির ধার ঘেঁষেই উঠছে বিশাল আকারের শপিং কমপ্লেক্স। প্রমোটারদের মিস্ত্রি হাজার লোকের আনাগোনা বিভূতিবাবুর জমিতেই। এমনকি অনুমতি ছাড়াই বাড়ির পেছনের পাঁচিলটিকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সারাদিন মেশিনের আওয়াজে নির্জন পরিবেশটাই কেমন যেন অসহ্য ও অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে। বাড়িটির এখন সংকটজনক অবস্থা। তার ওপর পার্টির ক্যাডার এবং প্রমোটাদের উৎপাত তো আছেই। তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান কথা দেন সাহিত্যিকের প্রাণের এই বাড়িটির সংরক্ষন ও ক্ষতিপূরণের। কিন্তু কাজ সেই কথা অনুযায়ী হয়ে ওঠেনি আজও। এখন সেই বাড়ির রূপটি বিভৎস ও ভয়ঙ্কর। যেকোনো মূহুর্তে ভেঙে পড়তে পারে দোতালার অংশগুলি। ফাটল ধরেছে বাড়িটিতে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে চলেছে বাড়ির কাঠামোটি। ঐ বাড়ির বর্তমান মানুষদের রয়েছে দুর্ঘটনার সম্ভবনাও। কর্মরত ইঞ্জিনিয়ারকে কাজ বন্ধ করার আবেদন জানালেও থামেনি কাজ। চেয়ারম্যানও কোনোরকম কথা শুনতে নারাজ একরকম।
বিভূতিভূষণ বাবুর পুত্রবধূর সম্প্রতি এই ঘটনা সম্পর্কিত ফেসবুক পোষ্ট সাড়া ফেলেছে। বাংলা তার অনন্য বঙ্গসন্তানদের স্মৃতি আগলেই এগোতে চায় ভবিষ্যতের মাটিতে। যে বাড়ি বাঙালির কাছে আবেগের, যে বাড়ি সংরক্ষিত করে বাঙালির কাছে সুন্দরভাবে তুলে ধরা উচিৎ ছিল। তার এমন দশা কি আশা করা যায়?
Discussion about this post