কথায় বলে, নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে বড় করে তোলে। তবে নামকরণ শুধুই মানুষের নয়, কোন নির্দিষ্ট স্থান কিংবা একটি জনপদের জন্য ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটি স্থাপত্যকে কেন্দ্র করে একটি স্টেশন কিংবা একটি জেলার নাম! শুনতে অবাক লাগলেও বাংলাদেশের ‘রাজবাড়ি’ জেলা তারই এক উদাহরণ। ঐতিহাসিকদের মতে, কোন একটি রাজবাড়িকে কেন্দ্র করেই এই জেলার নাম ‘রাজবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।
বাংলাদেশের নদীবেষ্টিত ‘রাজবাড়ি’ জেলার অবস্থান বেশ আকর্ষণীয়। দক্ষিণী পদ্মার শাখা নদী গড়াই নদীর পাশাপাশি এই জেলাকে ঘিরে রয়েছে পদ্মা, চন্দনা, গড়াই, হড়াই, কুমার ও চিত্রা নদী। এই জেলার পূর্বে রয়েছে মানিকগঞ্জ, পশ্চিমে কুষ্টিয়া, উত্তরে পাবনা ও দক্ষিণে রয়েছে ফরিদপুর। প্রাচীন এই জেলার পূর্ব পরিচিতি নিয়ে নানারকম মত পার্থক্য আছে। অনেকে বলেন, এটি আগে নাটোরের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবার অনেকের মতে, এই স্থান রাজশাহীর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রাচীন সময় থেকেই, এই ‘রাজবাড়ি’ অঞ্চল সমৃদ্ধ হিসেবে পরিচিত ছিল সারা দেশে। তবে ইতিহাস প্রেমীদের মতে, এই জেলা সৃষ্টির ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যময়। ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভের পর উত্তর-পশ্চিম ফরিদপুর অঞ্চল রাজশাহীর জমিদারির অংশ ছিল। নাটোরের রাজার জমিদারির চিহ্ন হিসেবে এই রাজবাড়ী জেলার বেলগাছিতে রয়েছে স্নানমঞ্চ, দোলমঞ্চ। এই অংশটি পরবর্তীকালে যশোর জেলার অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
১৮১১ সালে ফরিদপুর জেলা সৃষ্টি হলে ‘রাজবাড়ি’কে ফরিদপুরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৮৯৩ সালের ১৮ জুলাই থেকে সকল মান উন্নীত থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করার আদেশ জারি হয়। তখনই প্রথমবার ‘রাজবাড়ি’ উপজেলা হিসেবে পরিচিতি পায়। বর্তমানে ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত এই জেলা। ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা সংগ্রাম শাহের রাজকর্মচারীরা বর্তমান ‘রাজবাড়ি’ এলাকাকে সেই সময়ের কাগজে-কলমেও রাজবাড়ি লিখতেন। ১৮৯০ সালে সংগ্রাম শাহের উদ্যোগে রাজবাড়ি রেলস্টেশনটি স্থাপিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও রাজবাড়ি জেলার অবস্থান ইতিহাসের পাতায় উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর লক্ষ্মীকোলে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বিপক্ষ বাহিনীর যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। ১৬ ডিসেম্বর প্রায় সারা দেশে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও ‘রাজবাড়ি’ অঞ্চলে তাঁরা নিজেদের অধিকার বজায় রেখেছিল। বিপক্ষ বাহিনী ঘোষণা করেছিল রাজবাড়ি শহর পাকিস্তানের অধীনে থাকবে। এর পরেই মুক্তিযোদ্ধারা রাজবাড়ি শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন যুদ্ধের জন্য। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর বিপক্ষ বাহিনী রাজবাড়ির অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এভাবেই অতীতের বহু স্মৃতি আঁকড়ে রাজবাড়ি জেলা বাংলাদেশের মানচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য নাম।
Discussion about this post