“শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান, কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে…” – বাঙালির মনের কথা রবি ঠাকুরের চেয়ে ভালো আর কেই বা বোঝেন? সত্যি,এত আনন্দ-আয়োজনের পর শরতের শেষটি বড়ই বিষাদময়। কিন্তু ‘বারোমাসে তেরো পার্ব্বন’-এর মাঝে বাঙালির দুঃখ বিলাসের সময় কই? আলোর উৎসব যে চলেই এল! শারদোৎসবের মতই আবারও কাঁটাতারের বিভেদ ভুলে এপার বাংলার সাথে আনন্দে মেতে উঠবে ওপার বাংলা। এদেশের মতই বাংলাদেশেও রয়েছে ঐতিহ্যবাহী কিছু কালীমন্দির। সেগুলির সঙ্গে জড়িয়ে শতাধিক বছরের ইতিহাস। ময়মনসিংহের বড় কালীবাড়ি ও মায়ের পুজো তার মধ্যে অন্যতম।
এই মন্দিরের ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের। বাংলা তখন নবাব আলিবর্দী খাঁর শাসনাধীন। বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ তখন এক বৃহৎ পরগণা জেলা। তা একদিন ব্রহ্মপুত্র নদে মাছ ধরতে নামেন এক ধীবর। হঠাৎ জাল তুলতে গিয়ে তাঁর প্রচণ্ড ভারী লাগে। প্রথমে তিনি ভাবেন, বোয়াল জাতীয় বড় কোনো মাছ পড়েছে জালে। কিন্তু জাল টেনে তুলতেই তিনি দেখেন, জালে জড়িয়েছে এক কালী বিগ্রহ! অবাক বিস্ময়ে তিনি চিৎকার করে ওঠেন, “জয় মা কালী!” সেই কারণেই প্রতিষ্ঠার পর মন্দিরের নামকরণ হয় ‘শ্রীশ্রী জয় কালীমাতার মন্দির’। যাই হোক, বিগ্রহ পাওয়ার পর বিস্ময় কাটতেই একরাশ চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরে। কী করবেন তিনি বিগ্রহটি নিয়ে? সেদিন রাতেই তিনি স্বপ্নে দেখেন এক বিশাল বটবৃক্ষ। পরদিন সেই বটবৃক্ষের কাছে যেতেই তিনি দেখা পান একদল তান্ত্রিকের। তাঁদের হাতেই তিনি সমর্পণ করেন সেই বিগ্রহ।
তান্ত্রিকেরা ওই বটগাছের নীচেই একটি ছোট্ট ঘরে মাকে প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত আরাধনা করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে মন্দির স্থাপিত হলেও, প্রথম প্রতিষ্ঠার সেই বেদীটি আজও বর্তমান। প্রস্তরনির্মিত বিগ্রহ রূপে মা এখানে দক্ষিণা কালী। উচ্চতা ৩ ফুট। পদতলে শায়িত মহাদেব। মা কালীর সঙ্গেই মন্দিরে রয়েছে শিবলিঙ্গ, রয়েছে মনসা মন্দির, হনুমান মন্দির সহ বহু মন্দির। প্রতিদিন সকালে পুজো, দুপুরে অন্নভোগ ও রাতে শয়নারতির মাধ্যমে মায়ের নিত্য পুজো সম্পন্ন হয়। মায়ের প্রতিষ্ঠা দিবস ৮ই জ্যৈষ্ঠ। সেদিন হয় বলিদান। সাথে থাকে বোয়াল মাছের পদসহ অন্নভোগ। তাছাড়া প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবার বলি হয়ে থাকে। রাস পূর্ণিমাতে বিশেষ পুজো, বলিদান ও প্রসাদ বিতরণ হয়।
কালীবাড়িতে দীপাবলী উৎসব পালিত হয় মহা সমারোহে। আলোর মালায় সেজে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গণ। মন্দিরে ভক্তের সমাগম সারা বছরই লেগে থাকলেও, দীপাবলীর আড়ম্বর যেন ছাপিয়ে যায় সব কিছু! ২০১৭ সালের পুজোয় মায়ের মন্ডপসজ্জা দর্শনার্থীদের মন জয় করতে সফল হয়। ভারত সহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কার্নিভাল ও ম্যাগাজিনে স্থান পায় সেই পুজোর ছবি। এ বছর মহামারী সহ বিভিন্ন কারণে আয়োজনে হয়তো কিছুটা ভাঁটা পড়তে চলেছে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস, আবেগ ও ঐতিহ্য থেকে যাবে সেই একইরকম! ময়মনসিংহবাসীদের সাথে আপামর বাংলাদেশী, এমনকি আমরা ভারতীয়রাও মুখিয়ে আছি সেই মহোৎসবের সাক্ষী হব বলে!
চিত্র ঋণ – Quora, Webdunia
Discussion about this post