ভাগীরথীর গতিপথে অবস্থিত একটি প্রাচীন বাণিজ্য শহর কাটোয়া। কৃষ্ণনগর বা চন্দননগর যেমন জগদ্ধাত্রী পুজো কিংবা বারাসাত কালী পুজোর জন্য বিখ্যাত। ঠিক তেমনই কার্তিক পুজো ঘিরে উৎসবের সাজে সেজে ওঠে কাটোয়া শহর। তবে কাটোয়াতে কার্তিক পুজোর বিশেষত্ব শুরু নাম দিয়েই। কারণ কাটোয়ার কার্তিক পুজোর শোভাযাত্রা সারা বাংলায় ‘কার্তিক লড়াই’ নামেই খ্যাত।

ইতিহাসের পাতা উল্টোলে জানা যায় প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। কাটোয়া ছিল মুর্শিদাবাদের প্রবেশদ্বার। ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই এখানে ক্রমশ গড়ে উঠছিল এক বাবুসমাজ। এই বাবুদের আমোদ প্রমোদের জন্য ধীরে ধীরে কাটোয়ার চুনারি পাড়াতে গড়ে উঠতে শুরু করে নিষিদ্ধ পল্লী। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, কাটোয়া শহরের ঐতিহ্যবাহী এই কার্তিক পুজোর সূচনা হয়েছিল কাটোয়ার নিষিদ্ধপল্লী থেকেই। সন্ধ্যা নামলেই বাবুরা পৌঁছে যেতেন পতিতাদের পাড়ায়। বাবুদের খুশি করে মিলত অর্থ, বিলাস বহুল জীবনযাপন। কিন্তু এর পরেও কোথাও একটা খামতি থেকে যেত তাদের জীবনে। কোনও দুর্বল মুহূর্তে মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে পড়তেন তাঁরা। সেই আকুল বেদনা থেকেই এখানে শুরু হল কার্তিক পুজো। সেই কার্তিকই ছিল তাঁদের কাছে সন্তানসম।

যদিও সময়ের সাথে এই বণিক বাবুরাও জড়িয়ে পড়তে শুরু করে এখানকার কার্তিক পুজোর সঙ্গে। নিজের বারবণিতাটির দুঃখ ঘোচাতে, তাঁকে খুশিতে রাখতে এই বাবুরা কার্তিক পুজোয় অঢেল টাকা খরচ করতেন। আলো, ভোজ, গানবাজনা, শোভাযাত্রার জৌলস। আর চলত এসব নিয়ে ঘোরতর প্রতিযোগিতা। সকলের সামনে প্রতিযোগিতা চলত এক বারবণিতার সঙ্গে অন্য বারবণিতার। কিন্তু সকলের আড়ালে তা আসলে এক বাবুর সঙ্গে অন্যবাবুর। এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতারই নামকরণ হয় ‘কার্তিক লড়াই’ হিসেবে।

পুজোর দিন পথে কাটোয়ায় এক বড়সড় মিছিল নামে। সব পুজো-মণ্ডপ তাদের ঠাকুর নিযে বেরোয় শোভাযাত্রায়। চলে লড়াই ‘কার ঠাকুর আগে যাবে’। এ যুদ্ধ রীতিমতো ‘লাঠিসোটা’, এমনকী ‘তরোয়াল’ নিয়েও চলে। কার্তিক লড়াইয়ের অন্যতম আরও একটি আকর্ষণ সেখানকার মূর্তি। একসাথে ৩০-৪০ টি মূর্তি থাকে এক চালিতে। কিন্তু এত মূর্তি একটি চালিতে থাকতে সমস্যা হওয়ার জন্য বাঁশ কাঠ দিয়ে ত্রিভুজাকৃতি চালি তৈরী করা হয়। সিঁড়ির মত ধাপে রাখা হয় এই মূর্তি গুলি।

সময়ের প্রবহমানতায় অনেক রীতির পরিবর্তন হলেও সেই ন্যাংটো কার্তিকের পুজো আজও কাটোয়ার প্রাচীন সাংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ। সুঠাম গড়নের কাটোয়ার ল্যাংটো কার্তিকের লড়াই’ খুব বিখ্যাত। সেদিনের চুনারি পাড়া আজ হরিসভা পাড়া নামে পরিচিত। কাটোয়া শহরে পতিতাপল্লী আজ আর নেই। কিন্তু কার্তিক লড়াইয়ের ঐতিহ্য এখনও স্বমহিমায় রাজত্ব করছে। দূর দূরান্ত থেকে লক্ষাধিক মানুষ আসেন এই লড়াই দেখতে। গায়ের জোরে লড়াই না করেও, উৎসব নিয়ে আভিজাত্যের লড়াই কাকে বলে কাটোয়ার কার্তিক লড়াই স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।







































Discussion about this post