বাঙালির দিঘা আর দার্জিলিং। গ্রীষ্মের ছুটি হোক কিংবা শীতের, লিস্টে সবার ওপরে বোধহয় এই দুটো জায়গারই নাম। সন্ধ্যেবেলা দিঘার সমুদ্র সৈকতের ঠান্ডা হাওয়া সমস্ত স্ট্রেসকে ভুলিয়ে দেওয়ার অব্যর্থ ওষুধ। কিন্তু সেই ‘দিঘা’ নামটির উদয় কোথা থেকে হল তা কি জানা আছে? ‘দিঘা’ নামের নেপথ্যেও রয়েছে এক অজানা ইতিহাস।
তখন অষ্টাদশ শতাব্দী। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে মীরকাশিমকে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কিন্তু নবাবের সাম্রাজ্যের ‘চাকলা মেদিনীপুর’-এর দায়ভার কোম্পানির হাতে। এই চাকলা মেদিনীপুরের অধীনে ছিল বীরকুল পরগনা নামে একটি অঞ্চল। গভর্ণর ওয়ারেন হেস্টিংসের চোখে করে এই এলাকা। তিনি এই এলাকার নাম দেন ‘ব্রাইটন অফ ক্যালকাটা’। দিঘার মনোরম আবহাওয়া আকৃষ্ট করে তাকে। কলকাতার গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে ছুটি কাটাতে চলে আসেন এই এলাকায়। থাকবার জন্য ১৭৭৫ সালে একটি বাংলো নির্মাণ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে পাড় ভেঙে যায় এলাকার। হেস্টিংসের বাংলোও ডুবে যায় সেখানে। অগাস্টাস হিকি সম্পাদিত ‘বেঙ্গল গেজেট পত্রিকা’তেও পাওয়া যায় বীরকুলের উল্লেখ।
তবে প্রেমানন্দ প্রধানের ‘হিজলিনামা’ বই বলছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর আগেও ১৬৬৪ সালে ভ্যালেন্টিন এবং ১৬৬৮ সালে টমাস বৌরি মানচিত্রেও পাওয়া গিয়েছিল ‘নরিকুল’ নামক এলাকার হদিশ। যার অবস্থান ছিল বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে। অবশ্য পরবর্তীকালে রেনেলের মানচিত্রে নরিকুলের বদলে বীরকুলের নাম পাওয়া যায়। তবে বীরকুলের নাম দিঘা হওয়ার পেছনে রয়েছে স্থানীয় লোকের অবদান। এখানকার নদী ‘চম্পা’ বঙ্গোপসাগরে যেখানে মিশেছে, স্থানীয়রা সেই এলাকাকে দিঘি বলে ডাকতেন। মনে করা হয়, সেই ‘দিঘি’ই এখন দিঘা নামে খ্যাত।
তবে দিঘার আবিষ্কারক হেস্টিংস সাহেব হলেও, সেখানকার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন ‘হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি’র মালিক ফ্রাঙ্ক স্নেইথ। ১৯২৩ সালে বীরকুলের অস্তিত্ব জানার পর হাতির পিঠে চেপে তিনি উপস্থিত হন এলাকায়। এলাকার সৌন্দর্য্য এবং আবহাওয়া তাকে বাধ্য করে, তার শখের ‘রানসউইক হাউস’ নির্মাণ করাতে। বছরের ছয় মাস তিনি কাটাতেন তার এই বাড়িতে। ১৯৬৪ সালে ফ্রাঙ্ক সাহেব মারা গেলে এই বাড়িতেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এই বাড়িটি বর্তমানে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ এর অতিথিশালা পরিণত হয়েছে। তবে স্বাধীনতার পরে দিঘাকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার পিছনে ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সবথেকে বড় অবদান রয়েছে। কলকাতা-দিঘা সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা পরিকাঠামোয় উন্নতি করেছিলেন। তাহলে আর কি চাই, মনোরম পরিবেশের সঙ্গে এরকম এক ইতিহাস! মহামারীর প্রকোপ কমলে দু’দিন ঘুরে আসাই যায়, বাঙালির প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র থেকে।
Discussion about this post