১৯৩০ এর দশক। সমগ্র ব্রিটিশ ভারত জুড়ে গান্ধীজি আইন অমান্যের ঢেউ তুলেছেন। চরমপন্থী থেকে নরমপন্থী সকলের চোখে একই স্বপ্ন। ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশ মায়ের স্বাধীনতা। একদিকে আইন অমান্য আন্দোলন, অন্যদিকে বঙ্গদেশে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। ব্রিটিশরাও হাত গুটিয়ে বসে নেই। কিন্তু বিপ্লবীদের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রোচ্চারণে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেন জেগে উঠছে আরো শক্তি নিয়ে, প্রকাণ্ড রূপে। ১৯৩৩ সালের ২৭ শে অক্টোবরের মধ্যরাত্রি। ১৫ জনের সশস্ত্র বিপ্লবী দল জমায়েত হয়েছে হিলি রেল স্টেশনে। প্রাণকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, হৃষিকেশ, সত্যব্রত চক্রবর্তী, সরোজকুমার বসু, অশোকরঞ্জন ঘোষ, হরিপদ বসু, প্রফুল্লনারায়ণ সান্যাল, শশধর সরকার, কালীপদ সরকার, লালু পাণ্ডে, আবদুল কাদের চৌধুরি, কিরণচন্দ্র দে, রামকৃষ্ণ সরকার, বিজয়কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুবোধ দত্ত; এঁদের নিয়েই ছিল ১৫ জনের দল। হিলি-দার্জিলিং মেল লুট করতে পারলে জোগাড় করা যাবে বিপ্লবীদের প্রয়োজনীয় অর্থ। বিপ্লবী দল আরো শক্তিশালী হবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে।
অবিভক্ত দিনাজপুরের হিলি ছিল সেই সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। সেই হিলি-দার্জিলিং মেলেই ব্রিটিশ কোষাগারের এক বড় রকমের অংশ পারাপার হত। বিপ্লবী দল পরিকল্পনা মাফিক স্টেশনে রেলের অপেক্ষা করছে। বিপ্লবী প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী আছেন সেই দলের নেতৃত্বে। ঘড়ির কাঁটা বলছে সময় পেরিয়েছে রাত্রি ১২টা। কাজেই ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী,তারিখ ২৮ অক্টোবর। প্রতিটি নিঃশ্বাসও অতি সাবধানে নিতে হচ্ছে তাঁদের। বিপ্লবীদের দেখতে পেয়েই তাঁদের ওপর গুলি চালায় স্টেশন মাস্টার সতীশ চন্দ্র দে। বিপ্লবীরাও পাল্টা গুলি চালায়। রেলকর্মী কালীচরণ মাহাতো বিপ্লবীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। গুলির লড়াই চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীরা উদ্দেশ্যে সফল হন। মেলব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন ভাগে পালিয়ে যায় দল।
যদিও অর্থলোভী বর্বরের তো আর অভাব ছিল না দেশে। কুমারগঞ্জে নদী পারাপার হতে গিয়ে সেখানকার জমিদার ধরে ফেলে একদল বিপ্লবীকে। ১৫ জনের মধ্যে ১৩ জনকে তুলে দেওয়া হয় ব্রিটিশদের হাতে। আদালতে পেশ করা হয় তাঁদের।৪ জনের ফাঁসির সাজা শুনানি হয়। বাকিদের সশ্রম কারাদণ্ড। কিন্তু বিপ্লবীদের আইনজীবী নিশিনাথ কুন্ডু চালিয়ে যান দীর্ঘ আইনি লড়াই। যে করেই হোক ফাঁসির সাজা আটকাতেই হবে। অবশেষে তিনি সফল হোন। ৪ জনের ফাঁসির পরিবর্তে দেওয়া হয় কারাদণ্ডের আদেশ। হিলি মেল ডাকাতির ৮৮ বছর হয়ে গিয়েছে। আজ ভারত স্বাধীন। প্রতিটি বিপ্লবী নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও দেশ মায়ের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। ‘স্বর্গের চেয়েও প্রিয় জন্মভূমি’তে আজ দুর্নীতি, ধর্মকে নিয়ে হানাহানি এসবের ভিড়েই আমরা হারিয়ে ফেলেছি বিপ্লবীদের সেই স্বপ্ন। যাদের রক্তের বিনিময়ে এসেছিল আমাদের স্বাধীনতা। আমাদেরই কর্তব্য সেই স্বাধীনতার স্বপ্নকে অক্ষুণ্ণ রাখা।
Discussion about this post