‘আমি গান শোনাবো একটি আশা নিয়ে’, কন্ঠের আবেগ এমনই যে তাঁর গান শোনা যায় একটানা, নিভৃতে। তাঁর গায়কিতে অন্য মাত্রা পেত সেকালের ছায়াছবির গান। ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’, ‘ওলির কথা শুনে বকুল হাসে’, ‘জানে ওহ ক্যায়সে লোগ থে’, ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’র মতো সুপারহিট গান গেয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মাতোয়ারা করেছেন বাংলা, হিন্দীর শ্রোতা, অনুরাগীদের। নামে হেমন্ত কিন্তু কন্ঠে তিনি ছিলেন চিরবসন্ত।
বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় গানগুলো জলসায় লাইভ শোনার উন্মাদনাই ছিল আলাদা। এমনই এক নামকরা অনুষ্ঠানের আয়োজন হল পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে। কলকাতার এমন কোনো সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন না যিনি ওই অনুষ্ঠানে ডাক পেতেন না। প্রতি বছরের মতো সেবারও উপস্থিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভত্তাচার্য, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বাংলা ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতা ও শিল্পীরা। পছন্দের শিল্পীকে চাক্ষুষ করতে থিক থিক করছে দর্শকাসন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে লাফিয়ে আসছে একের পর এক গানের অনুরোধ। ছুড়ে দেওয়া সশ্রদ্ধ অনুরোধ আর লুফে নেওয়া গানে দ্রুত বদলাচ্ছে প্রেক্ষাগৃহের পারদ। হঠাৎই এলো তাঁর সুপারহিট হিন্দি গান ‘না তুম হামে জানো’র অনুরোধ। ক্ষণিকের ছন্দ পতন। হেমন্তবাবু পরিষ্কার জানালেন বাঙালির বৈশাখী সন্ধ্যায় হিন্দি গান তিনি গাইবেন না। গানহীন নিস্তব্ধতায় সবাই তাকিয়ে রইল শিল্পীর মুখের দিকে।
সুরের আবেদনের কাছে ভক্তরা সর্বদাই বিহ্বল। তাই শেষ অবধি ছন্দ পতন ঘটেনি সেদিনের আমেজে। তাঁর গায়কিতে মুগ্ধ হয়ে সবাই তখন ‘এই মেঘলা দিনে একলা’তে আচ্ছন্ন। বাংলা গানের ইতিহাসে তাঁর গান এবং সুরের আকর্ষণ ছিল এমনই। যখন কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে চাইতো না তিনি একা প্রতিটা আসর শুরু করতেন দু’টো আলাপি রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়ে। জলসায় দর্শকাসন থেকে মানুষ উঠে গিয়ে সিগারেট খেয়ে ফিরে আসতো শুধুমাত্র রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনবে না বলে। বসুশ্রীর এহেন বিরাট বর্ষবরণ অনুষ্ঠানেও এই নিয়মের অন্যথা ঘটাননি তিনি।
সঙ্গীত ভাষার ব্যবধান মানে না, বিশেষ ক্ষমতায় সুর ছুঁয়ে যায় দেশ কাল পাত্র নির্বিশেষে। একথা যথার্থই বলা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর গানের জীবনে বাংলা হিন্দি ছাড়াও পনেরোটি আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় দু’হাজারেরও বেশি গান গেয়েছিলেন। গান গেয়েছিলেন সংস্কৃত ও উর্দু ভাষাতেও। ‘ভয়েস অফ গড’ না হলে এ কাজ সম্ভব হত না। বাংলা আধুনিক গান, প্লে-ব্যাক, বাংলা ও হিন্দি গানের গায়কির কথা বললে তাই আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
Discussion about this post