বাংলার সংস্কৃতিতে পুতুল শিল্পের এক বিশেষ স্থান রয়েছে। শুধু শিশুদের খেলনা হিসেবেই নয়, বরং ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও লোককাহিনী বহন করে নিয়ে চলেছে এই পুতুল শিল্প। এগুলি কেবল কারুশিল্পের নিদর্শনই নয়, বরং বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা ও মূল্যবোধেরও প্রতিফলন। বিভিন্ন উপাদানে তৈরি রঙিন ও আকর্ষণীয় এই পুতুলগুলি আজও আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন ধরনের পুতুল তৈরির জন্য বিখ্যাত। তালিকায় রয়েছে – হাওড়ার রানি পুতুল, মজিলপুরের পুতুল, পাঁচমুড়ার বোঙা হাতি ও ঘোড়া, নদীয়ার পোড়ামাটির পুতুল, পুরুলিয়ার তালপাতার পুতুল কিংবা বিষ্ণুপুরের হিঙ্গুল পুতুল। হিঙ্গুল পুতুল হিম পুতুল নামেও পরিচিত।
হিঙ্গুল পুতুল বিষ্ণুপুরের একটি বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী পুতুল। এটি একটি লোকশিল্প যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। এই পুতুলগুলি মূলতঃ মাটি দিয়ে তৈরি। ষষ্ঠী পুতুলের এক বিশেষ ধরন এই হিঙ্গুল পুতুল। তবে ষষ্ঠী পুতুলের কাঁখে শিশু থাকলেও হিঙ্গুল পুতুলের ক্ষেত্রে এরূপ দেখা যায় না। হিঙ্গুল পুতুলগুলির সাজসজ্জায় লক্ষ্য করা যায় ইউরোপীয় সংস্কৃতির ছাপ। পুতুলগুলির পরনে থাকে ফ্রক আর মাথায় থাকে পশ্চিমি ধাঁচের টুপি। বাচ্চাদের খেলনা হিসেবে এবং ঘর সাজানোর জন্য এই পুতুল জনপ্রিয়।
হিম বা হিঙ্গুল এক ধরনের খনিজ পদার্থ। আগে বিষ্ণুপুরের এই পুতুলগুলিকে রাঙিয়ে তুলতে লালচে রঙের এই পদার্থ ব্যবহার করা হত। এই রঙ দিলে পুতুলগুলি বেশ চকচকে হত। এই কারণে এই পুতুলগুলির নাম হিম বা হিঙ্গুল পুতুল। তবে এখন শুকনো গুঁড়ো রঙ দিয়েই এই পুতুলগুলিকে রঙ করা হয়। কাঁচা মাটিকে হাতের সাহায্যে পুতুলের রূপ দিয়ে তা রোদে শুকোনো হয়। পরে তাতে ভেষজ রঙের প্রলেপ লাগানো হয়। এই পুতুলগুলি সাধারণতঃ ছোট আকারের হয় যার উচ্চতা এক আঙুলের মতো।
বর্তমানে বিষ্ণুপুরের শীতল ফৌজদারের পরিবার হিম পুতুল তৈরি করেন। শীতল ফৌজদার হলেন কার্তিক ফৌজদারের বংশধর। কার্তিক ফৌজদারই প্রথমবার মল্ল রাজা বীর হাম্বীরের জন্য দশাবতার তাস তৈরি করেছিলেন। তারপর থেকে তাঁদের পরিবার বংশপরম্পরায় এই পুরনো শিল্পের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাড়ির মহিলারাও এই পুতুল বানানোর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে। শীতল ফৌজদারের থেকে জানা যায়, “আমরাই হিঙ্গুল পুতুলের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছি। আমরা চাই, আরও বেশি মানুষের কাছে যাতে আমাদের কাজ পৌঁছায়। বাংলার মানুষ এই পুতুলকে রক্ষা করতে আরও বেশি করে এগিয়ে আসুন।”
চিত্র ঋণ – কল্যাণী মুখার্জী, প্রসূন বিশ্বাস, সৌমেন নাথ, মানব মন্ডল
Discussion about this post