ইতিহাসের লতায় পাতায় কত অজানা তথ্যের ভিড়। পল্লীর আঁকেবাঁকে পুরোনো ঐতিহ্যের সূত্র ধরা রয়েছে আজও। তেমনই একটি গ্রাম বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার ঝিটকা। যেখানে কোনো একসময় পা রেখেছিলেন ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ। ভারতের সিংহাসনে তখন সম্রাট আকবরের অধ্যায়। মানিকগঞ্জের গুড়ের মাতোয়ারা গন্ধ ও স্বাদের মিষ্টতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং রানি। এই গুড় হাতে নিয়ে আলতো চাপ দিলেই ভেঙে যায় অনায়াসে। রাণী এলিজাবেথ গুড় খেয়ে এতটাই গুণমুগ্ধ ছিলেন যে ‘হাজারি’ নামের সিলমোহরও উপহার দেন। কিন্তু কে এই হাজারি? গুড়ের এত প্রসারতাই বা হল কীভাবে?
কয়েকশ’ বছর আগেকার কথা। হাজারি প্রামাণিক নামের এক গাছি ঝিটকা অঞ্চলে থাকত। সাধারণ এক খেজুর গুড় ব্যবসায়ী। কিন্তু একদিন অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হল সে। প্রতিদিনের মতোই বিকেলের দিকে সেদিন খেজুর গাছে হাঁড়িটা বেঁধে নিচে নেমেছে হাজারি গাছি। এক সাধু তখনই এসে উপস্থিত। গাছির কাছে কাঁচা খেজুররস খেতে চাইলেন। গাছিও জানায় এত কম সময়ে কিভাবে রস জমা হবে? কিন্তু সাধু নাছোড়বান্দা। শেষমেশ হাজারি গাছি বাধ্য হয়ে গাছে উঠল হাঁড়ি নামাতে। কিন্তু এ কি আশ্চর্যজনক ঘটনা! হাঁড়িতে অনেকটা পরিমানের রস ভরা। এই অসম্ভব ঘটনা দেখেই গাছি সাধুর পা জড়িয়ে ধরে বসে। সাধু তাকে বুকে টেনে বলেন হাজারি গাছির গুড় এবার দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। আর ঠিক তাই হল। পরে খুঁজেও সেই সাধুর দেখা মেলেনি। কিন্তু হাজারি নামের গুড়ের খ্যাতি আজও অনন্য।
পৌষের প্রথমভাগ। বিকেল সন্ধ্যের দিকে হাঁড়ি বাঁধা হয় খেজুর গাছে। কাকভোরে সে হাঁড়ি নামিয়ে আগুন আঁচে কাঁচারস জ্বাল দিতে বসানো হয়। রসের ঘনত্ব বাড়লে মাটির হাড়িতে বিশেষ পদ্ধতিতে ঘুটে ঘুটে তৈরি হয় সাদা রঙের হাজারি গুড়। খাঁটি গুড় পেতে এক সপ্তাহ আগে থেকে অর্ডার দিতে হয় গাছি বাড়িতে। ১২ লিটার রসে প্রায় এক কেজি গুড় তৈরি হয়। দামটাও বেশ চড়া, কেজি প্রতি ১৪৫০-১৫০০ টাকা।
তবে বর্তমানে খেজুর গাছকে বাতিলের খাতায় ফেলেছে মানুষ। তাই খেজুররসের ঘাটতি বেশ চোখে পড়ে। তার ওপর অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজারি সিলমোহর লাগিয়ে বিক্রি করে চলেছে প্রসিদ্ধ এই গুড় মাখা সন্দেশ। তবে নেওয়া হচ্ছে সতর্কতা। মানিকগঞ্জকে সরকারিভাবেই হাজারি গুড়ের ব্র্যান্ডিং ক্ষেত্র করা হয়েছে। ঐতিহ্যের সাথে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আজও ‘ঝিটকার হাজারি গুড়’।
সম্পাদনায় অনন্যা করণ
Discussion about this post