চড়ুই প্রকৃতির একটি চঞ্চল পাখি। এরা মানুষের আশপাশে বসবাস করতে ভালোবাসে। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে চড়ুই মানুষের সান্নিধ্যে আসে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এদের কিচিরমিচির গান চারপাশকে জাগিয়ে তোলে। ভাবতে অবাক লাগে, গায়ক চড়ুইরাই ৯০ টি সুরে গান গাইতে পারে! আমাদের ঘরবাড়ি, আশপাশের ভাঙা দালান এবং বড় ও বুড়ো গাছের গর্তে এরা বাসা বাঁধে।
মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট চিনের সাথে চড়ুইপাখিদের এক লড়াই হয়েছিলো ১৯৫৮ সালে। মাওয়ের চীনে যতগুলো অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে তার অন্যতম হয়ে রয়েছে ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’। সে বছর মাও চারটা প্রাণীকে চীনের উন্নয়নের জন্য বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই তালিকায় ছিল ইঁদুর, মশা, মাছি এবং চড়ুই। বিশেষ করে ইউরেশিয়ান গেছো চড়ুইকে মারার জন্য টার্গেট করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার কাছে আসা রিপোর্টে বলা হয়েছিল, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল খেয়ে ফেলে আমাদের চারপাশে বসবাসরত চড়ুই পাখির দল। আর তাই এ সমস্যার সমাধানে দেশ থেকে সব চড়ুই পাখি মেরে ফেলার নির্দেশে সিলমোহর দিলেন মাও সে তুং।
গণহারে শুরু হলো চড়ুই মারা। কিন্তু প্রায় ৯৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটি থেকে রাতারাতি চড়ুই পাখি বিলুপ্ত করে দেয়া তো আর যেমন তেমন কথা না। তাই কীভাবে চড়ুই পাখি মারা যায়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণাও চালানো হয়েছিল। লোকে ড্রাম আর থালা হাতে রাস্তায় নেমে পড়ত, চড়ুই দেখলেই বাজানো শুরু করতো। প্রবল বাদ্যযন্ত্রের শব্দে সহজেই ভীত হয়ে পালাতো চড়ুই। কিন্তু চারপাশের ক্রমাগত আওয়াজে একসময় দুর্বল হয়ে হৃদপিণ্ড থেমে যেত ছোট্ট পাখিগুলোর।
দেশপ্রেমের টানে দলে দলে চড়ুই নিধন কর্মসূচীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সকলে। সাংহাইয়ের একটি পত্রিকা সেই দিনটির বর্ণনা করেছিল এভাবে, “১৩ই ডিসেম্বর সকালে, সবখানে বেজে উঠলো চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা। বড় ছোট সড়কগুলোতে দেখা গেল লাল পতাকা। চারিদিকে উঠে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য কাকতাড়ুয়া, কুশ পুত্তলিকা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারী অফিসের কর্মী, কারখানার শ্রমিক, কৃষক, পিপল’স লিবারেশন আর্মি সকলেই ছুটে চলেছে যুদ্ধের জয়গান গেয়ে। মূলতঃ কম বয়সী মানুষের ঘাড়ে পড়েছে চড়ুই পাখি ধরা, তাড়া করা, বিষ দিয়ে মারার মতো কাজগুলো। আর বৃদ্ধ ও শিশুদের দেয়া হয়েছে প্রহরীর দায়িত্ব। শহরের কারখানাগুলোর শ্রমিকেরাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছে। গৃহিণীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন থালা, বাটি, হাড়ি, পাতিল নিয়ে। চামচ বা লাঠির আঘাতে সেগুলোকে ঢোল হিসেবে ব্যবহার করে নাগরিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছিলেন তারা। চড়ুই পাখির বাসা নষ্ট করা, ডিম ভেঙে ফেলা, গুলি করা, বন্দী করে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ছিল সেদিনকার বীভৎস কর্মসূচীর মুখ্য অংশ।
চড়ুই নিধন সংক্রান্ত এক করুণ ঘটনার সাক্ষী ছিল বেজিংয়ে অবস্থিত পোলিশ দূতাবাস। শোনা যায় আশেপাশে লোকের আক্রমণে টিকতে না পেরে প্রচুর চড়ুই পাখি দূতাবাসের ভেতরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পোলিশ কর্তৃপক্ষ চিন সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও দূতাবাসের ভেতর চড়ুই নিধনকারীদের ঢোকা নিষিদ্ধ করে মানবতার খাতিরে। এতে ক্ষেপে গিয়ে এম্বেসি ঘিরে হাজার হাজার লোক রাতদিন ড্রাম বাজাতে থাকে। ড্রামের বিকট শব্দে হার্টফেল করে মারা যায় অনেক চড়ুই। এভাবে টানা দুইদিন বাজানোর পর লোকজন সরে গেলে দেখা যায় দূতাবাসের উঠানে এত পরিমাণ মরা চড়ুই পড়ে আছে যে তাদের লাশ সরানোর জন্য পোলিশদের বেলচা পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছিল।
চিনাদের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতেও বেশি সময় লাগলো না। ধেয়ে এলো প্রকৃতির নির্মম আঘাত। প্রথমত, শস্য দানার পাশাপাশি চড়ুই পাখি নানা ধরনের পোকামাকড়ও খায়। চড়ুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল সেসব পোকামাকড়ের সংখ্যা। পঙ্গপাল সহ ফসলের ক্ষেত ছেয়ে যেতে লাগলো ক্ষতিকর পোকামাকড়ে। ফলস্বরূপ যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হল, সেই শস্য গেল পোকামাকড়ের পেটে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। খাদ্য সংকটের মুখে পড়লো কোটি কোটি মানুষ। ‘দি গ্রেট চাইনিজ ফ্যামিন’ নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারান প্রায় দেড় কোটি মানুষ।শেষমেশ চিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লাখ চড়ুই আমদানি করতে বাধ্য হয়। এই চড়ুই সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে চীন আস্তে আস্তে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দিতে সক্ষম হয়। সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ চড়ুইপাখি আমদানি করার মত অদ্ভুত আরেক রেকর্ডেরও জন্ম দেয় মাও সে তুংয়ের চীন!
তথ্য ঋণ – শত্রুঘ্ন অর্পিত, বিজন চ্যাটার্জী
চিত্র ঋণ – Fatfinch, Alberton Record, Topical Press Agency
.
Discussion about this post