শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈব সংস্কৃতির সমাহারে ঐতিহাসিক পীঠস্থান নবদ্বীপ ধাম। রাসোৎসব,নবদ্বীপের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কার্তিকী পূর্ণিমায়, শ্রীকৃষ্ণ এবং ব্রজের গোপীদের সঙ্গে প্রেমলীলা কাহিনীই রাস উত্সব নামে পরিচিত হয়। শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য ব্রজের গোপীরা যখন মহামায়ার সাধনায় নিমগ্ন হয়। তখন শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের আশ্বাস দেয় যে তাদের সঙ্গে তিনি মিলিত হবেন৷ কার্তিকী পূর্ণিমায় রাসলীলায় রসিক শ্রীকৃষ্ণ মিলিত হলেন, সেই স্মৃতিকে স্মরণ করে প্রতি বছর কার্তিকী পূর্ণিমাতে রাসযাত্রা শুরু হয়৷
রাসোৎসবের নবদ্বীপের সুউচ্চ প্রতিমাগুলির মাঝে অন্যতম জোড়া বাঘ গৌরাঙ্গিনী। তার আরাধনা বাংলার হাজার হাজার বছরের শক্তি আরাধনার অতিহ্য বহন করছে।আরাধ্যা মহিষাসুরমর্দিনী দেবী গৌরাঙ্গিনী রূপে সমগ্র জগৎবাসী ও দেবকূলকে অভয় প্রদান করেন। স্বয়ং দেবতারা এই রূপে তার আরাধনা করেছিলেন। দেবী এখানে প্রবল পরাক্রমশালী। তিনি এই জগৎকে ধারণ করে আছেন। তার বাহন জোড়া সিংহ অনন্ত বীরত্বের প্রতীক।
নবদ্বীপের রাসের অন্যতম আকর্ষণ শোভাযাত্রা। মণ্ডপের বিশাল মূর্তিকে বিশেষ ভাবে নির্মিত গাড়িতে চালিয়ে বাজনা ও আলোকসজ্জা সহকারে শোভাযাত্রা বের হয়৷ মূলত বেশিরভাগ শোভাযাত্রা রাতে বের হলেও, মা গৌরাঙ্গিনীর শোভাযাত্রা হয় দুপুরে। ঐতিহ্য মেনে মা গৌরাঙ্গিনীর শোভাযাত্রা হয় গাড়ির বদলে, মায়ের বিশ্বস্ত বেয়ারাদের কাঁধে চেপে। হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন, প্রায় ১৮ হাতের বড় প্রতিমা কাঁধে চেপে। লোকমতে,অতীতে যতবার গাড়িতে করে গৌরাঙ্গিনী মাতাকে শোভাযাত্রাতে বের করার চেষ্টা হয়েছে, কোনো না কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতেই হয়েছে। তাই কয়েকশো বছরের ঐতিহ্য বজায় রেখে আড়ংয়ের দিনই ঐতিহ্য মেনে ১০৮ জন বেয়ারার কাঁধে চেপে নবদ্বীপ ধামের প্রায় ৪ কিমি পথ ভ্রমণ করে দেবী প্রতিমা সন্নিহিত গঙ্গায় পৌঁছয় নিরঞ্জনের জন্য।
দুপুরে গৌরাঙ্গিনী ঠাকুরকে কাঁধে নিয়ে শোভাযাত্রা। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকে আদিবাসী নৃত্য, বাজনা৷ কয়েক হাজার ভক্তবৃন্দ দেবী প্রতিমার পিছু নিয়ে দেবীকে অনুসরণ করেন। গৌরাঙ্গিনী মাতা পুজো কমিটির সদস্য সদস্যদের কথায় – “অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠার সাথে মায়ের পুজো সম্পন্ন হয়। এছাড়াও কাঁধে চেপে ঘোরা মায়ের ঐতিহ্য।” তবে নিজেদের সত্ত্বা বজায় রেখেও, কো-১৯-এর কারণে ২০২০ এবং ২০২১ দু’বছরই প্রতিমার উচ্চতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুজো কমিটি। যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পুজো কমিটির কথায়, এতে লোক জমায়েত কিছুটা কমানো যাবে। প্রতিমার উচ্চতা নয় মানুষের প্রাণ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
সময় বের করে একবার চলেই আসুন নবদ্বীপের রাস পূর্নিমা দেখতে। এত বৈচিত্র বাংলার কোথাও নেই। অবশেষে নবদ্বীপের রাসোৎসব নিয়ে কার্টুনিষ্ট চণ্ডী লাহিড়ির মতে, “নবদ্বীপের মূর্তির বিশালত্বের মধ্যেও প্রতিটি অংশের সুষমা অক্ষুণ্ণ রাখা, বিভিন্ন দেবতার শাস্ত্রীয় কল্পনাকে মাটির সাহায্যে বাস্তবে রূপায়িত করা বিশ্বের যে কোন দেশের পক্ষে যুগপৎ বিস্ময় ও গৌরবের বস্তু।”
Discussion about this post