নানা ধরনের বহু প্রাচীন রীতি-নীতিতে পরিপূর্ণ হিন্দু ধর্ম। হিন্দু ধর্মে মানা হয়, ভাগ্যবান ভক্তের বোঝা ভগবানই বয়! কিন্তু স্বয়ং ভগবান মর্ত্যে আসেন ভক্তের শ্রাদ্ধ করতে। শুনতে অবাক লাগলেও, এমনই মনে করেন অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দিরের ভক্তরা। পূর্ব বর্ধমানের অন্যতম প্রাচীন শহর অগ্রদ্বীপ। গঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা অগ্রবর্তী গ্রাম হিসেবেই এই নামকরণ। এখানেই রয়েছে ৫০০ বছরের পুরনো গোপীনাথ মন্দির। চৈত্র মাসে দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা একাদশীতে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে এক বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। কারও কারও মতে দর্শনার্থীর সংখ্যা ৫-৬ লক্ষও ছাড়িয়ে যায়। এই মেলার সাথে জড়িয়ে প্রাচীন এক রোমহর্ষক কাহিনী। অধিকাংশ মেলা কোনও পুজো পার্বণকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হলেও, গোপীনাথের মেলা তাদের সবার থেকে আলাদা। লোকমতে, এই মেলার আয়োজন করা হয় শ্রাদ্ধ দিবস উপলক্ষ্যে।
মেলার উদ্যোক্তাদের মতে, এই মেলার আবির্ভাব রহস্য লুকিয়ে ৫০০ বছরের পুরনো ইতিহাসে। কাটোয়ার তখনকার নাম ছিল গন্ডগ্রাম। মহাপ্রভুর নীলাচলে যাত্রার কয়েকজন শিষ্যের মধ্যে গোবিন্দ ঘোষ ছিলেন একজন। দীর্ঘ যাত্রাপথে ভাগীরথীর তীরে অগ্রদ্বীপে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামেন মহাপ্রভু ও তার শিষ্যরা। বিশ্রাম শেষে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় মহাপ্রভু গোবিন্দ ঘোষকে অগ্রদ্বীপে থেকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। জানা যায়, গোপীনাথের প্রতিষ্ঠা হয় গোবিন্দ ঘোষের হাতেই।
একসময় গোবিন্দ ঘোষ সন্ন্যাসধর্ম পরিত্যাগ করে সংসারধর্ম পালনে আগ্রহী হলেও অল্প দিনের মধ্যেই হারান তার স্ত্রী ও পুত্রকে। এরপর গোপীনাথের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন গোবিন্দ ঘোষ। প্রচলিত লোকগাথা থেকে জানা যায়, বৃদ্ধ বয়সে তিনি তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া নিয়ে মুষড়ে পড়েন। তখন গোপীনাথ স্বয়ং তাকে কথা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া তিনিই করবেন। প্রথা মেনে আজও ঘোষ ঠাকুরের প্রয়াণ তিথি পালন করা হয়। ‘চিঁড়ে মহোৎসব’-এর মধ্য দিয়ে মেলার শুরু। মন্দির থেকে গোপীনাথ বিগ্রহকে কাছা পরিয়ে নিয়ে আসা হয় গোবিন্দ ঘোষের সমাধি মন্দিরে। দেবতার হাত দিয়ে তার মানব পিতার কুশ ও পিণ্ডদান করা হয়। আগত পুণ্যার্থীরা এদিন অরন্ধন পালন করেন। দ্বিতীয় দিনে অন্ন মহোৎসব, তৃতীয় দিন গঙ্গা স্নান, চতুর্থ দিন স্থানীয় ভাবে পালিত গোপীনাথের দোলের মাধ্যমে মেলা শেষ।
যত দিন যাচ্ছে ততই নতুন করে জনজোয়ারে ভাসছে অগ্রদ্বীপের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা। বহু দূরদূরান্ত থেকে বিক্রেতারা আসেন এই মেলাতে। তাদের মতে, “বছরের বিভিন্ন মেলাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এই মেলাতে আসার জন্য প্রায় ১ মাস আগে থেকে গোছাতে হয় সামগ্রী।” আধুনিকতার ভিড়েও গ্রাম বাংলার প্রাচীন আস্থার এক অন্যতম আকর্ষণ এই মেলা।
আগে অগ্রদ্বীপের খ্যাতি ছিল ছিল বারুণীর স্নান উৎসবের জন্যই। এই বারুণী স্নান হয়, চৈত্রের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে। জনশ্রুতি আছে, এই উৎসবের সূচনা শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাবের অনেক আগেই। বহু দিন থেকেই বাংলা, বিহার, বাংলাদেশ এবং ওডিশার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ অগ্রদ্বীপে বারুণীর স্নানে শামিল হতে আসতেন। রেভারেন্ড ফাদার জেমস লঙের ‘দ্য ব্যাঙ্কস অব ভাগীরথী’ থেকে জানা যায়, ১৮২৩ সালে অগ্রদ্বীপের এই গোপীনাথ-বারুণী মেলার আগত ভক্তের সংখ্যা ছিল এক লক্ষের বেশি। মেলার সামগ্রী বিক্রি হয়েছিল আনুমানিক বারো লক্ষ টাকারও বেশি। সেই সময় নাকি, গঙ্গাসাগর মেলার থেকেও অগ্রদ্বীপের বারুণীর স্নানের খ্যাতি বেশি।
চিত্র ঋণ – কৌশিক ঘোষ
Discussion about this post