বাংলার লোকসংস্কৃতির এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় মেলা হল গাজন মেলা। নীল ও চড়ক পুজো এই মেলার প্রধান অঙ্গ। বাংলা ক্যালেন্ডার মেনে চৈত্র মাসে গাজন মেলা হয়। গ্রাম বাংলাতে সাধারণত এই মেলাগুলি হয়ে থাকে। বাঁকুড়া জেলার বিভিন্নস্থানে গাজন অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ বাঁকুড়ায় শিলাবতী নদীর ধারে ধারে অসংখ্য জনপদ আছে। তার মধ্যেই প্রাচীন এক জনপদ হল গাঁড়রা গ্রাম। যেটি খাতড়া ও সিমলাপালের মাঝে অবস্থিত। এই গ্রামেই আছে বহু প্রাচীন এক শিবলিঙ্গ। যার নাম শান্তিনাথ। কে কবে এই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিল তার কোনো ইতিহাস নেই। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, শান্তিনাথ ‘স্বয়ম্ভু শিব’, অর্থাৎ তিনি নিজেই মাটি ফুঁড়ে উঠেছেন। এই শিবের শান্তিনাথ নাম কীভাবে হল তার কোন উল্লেখ নেই। কখন থেকে তিনি এই নামে পরিচিত হতে শুরু করলেন তার কোন ইতিহাসও নেই।
প্রথমদিকে এই শিবের কোনো মন্দির ছিলনা। খোলা জায়গাতেই পুজো করা হত। শোনা যায়, আজ থেকে প্রায় সত্তর-আশি বছর আগে এক সন্ন্যাসী এসে এখানে ঘাঁটি গাড়েন। ভিক্ষা করে কিছু টাকা-পয়সা জমিয়ে মাকড়া পাথরের ভিত্তি ও কিছুটা দেওয়াল তোলেন। তারপর তিনি হঠাৎই সব ছেড়ে চলে যান। পরে সেই ভিত্তির ওপর ইটের দেওয়াল তুলে মন্দির সম্পূর্ণ করা হয়। শান্তিনাথ শিবের প্রতিদিনের পুজো, প্রতি সোমবারের পুজো তো হয়ই; তাছাড়াও চৈত্র মাসে এখানে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়।শান্তিনাথের পুজোর দায়িত্বে আছেন গাঁড়রা গ্রামের চক্রবর্তীরা। এঁদের পূর্বপুরুষকে পুরোহিত করেছিলেন ভেলাইডিহার রাজা। ভেলাইডিহা, শিলাবতীর অন্য পারের একটি গ্রাম।
গাজনের সময় যারা ‘সন্ন্যাস ব্রত’ নেন, তাঁদের বলা হয় ‘ভক্ত্যা’। ব্রতের কদিন তাঁদের থাকা-খাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব থাকে ঐ রাজপরিবারের।ভক্ত্যা সারাদিন জল ও শরবত পান করেন। রাত্রে শুধু হবিষ্যি করেন। এক কাপড়ে থাকেন। সকাল-বিকাল দু’বার স্নান করে মন্দিরে গিয়ে শিবের পুজো করেন। মাটিতে শুধুমাত্র চাটাই পেতে শুতে হয়। গাজন মেলার শেষদিন বিকেলে শিলাবতীতে স্নান করে শান্তিনাথের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে আসেন তাঁরা। ভক্ত্যারা ডান্ডিয়া খেলার ঢঙে লাঠি খেলতে খেলতে মন্দিরে এসে মহাদেব পুজো দিয়ে ব্রত শেষ করেন। একবার ভক্ত্যা হলে পর পর তিন বছর ভক্ত্যা হতে হয়। এমনটাই নিয়ম।
গাজনে গা শিউরে ওঠা বিভিন্ন নিয়ম আছে। যারা মানত করে তারা এই নিয়ম গুলি পালন করে থাকে। যেমন, শীলাবতীর জল থেকে মাটিতে গড়াতে গড়াতে একবারও না উঠে মন্দির অবধি আসাকে বলে, ‘লোটন সেবা’। পেরেক পোঁতা মানুষ আকৃতির তক্তার ওপর শুয়ে নদী থেকে মন্দির অবধি আসাকে বলে,‘পাটভক্ত্যা’। এছাড়াও আছে, ‘আগুন সেবা’, ‘ছেল্যাকাঁদা’ ইত্যাদি। আগে গাজনকে কেন্দ্র করে মন্দিরের সামনে বিশাল মেলা বসত। প্লাস্টিকের খেলনা, বেলুন, শোলার খেলনা, তালপাতার পাখা, মিষ্টি জিলিপির দোকান, ঘুগনি, চাঁদমালা-বাতাসার দোকান, চপ-তেলেভাজার দোকান বসত। চারদিক ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ হয়ে যেত। খোলা জায়গার অভাবে মেলার বহর বেশ কমে গেছে। তবে আগের মতো এখনও প্রচুর মানুষের ভিড়ে সরগরম হয়ে ওঠে শান্তিনাথের গাজন।
চিত্র ও তথ্য ঋণ – জিয়ো বাংলা
Discussion about this post