পশ্চিম বাংলার মানুষের প্রাচীন লোক-সংস্কৃতির নির্দশন হল গাজন উৎসব ও চড়ক পুজো। চৈত্রের শেষ দিনগুলো ধরে চলে এই উৎসব। গাজনের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে পালিত হয় চড়ক। পল্লীগ্রামের উৎসব হলেও বাংলার প্রায় সমস্ত মানুষের রোজকার কথাবার্তায় উল্লেখ পাওয়া যায়। কোনও বিষয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেউ বেশি কথা বললে ‘ধান ভানতে শিবের গাজন’ অথবা অবাক হয়ে গেলে ‘চক্ষু চড়কগাছ’। এই দুটি প্রবাদ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পাকাপাকি ভাবেই জড়িয়ে রয়েছে। ‘গাজন’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘গর্জন’ শব্দটি থেকে। বিশেষ করে সন্ন্যাসীদের হুঙ্কার বা গর্জন থেকেই ‘গাজন’ কথাটির জন্ম বলে মনে করেন বিশিষ্ট গবেষক যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। আবার অনেকের মতে, গাজন উৎসবের মধ্যে বৌদ্ধ প্রভাব রয়েছে।
বাংলায় মঙ্গলকাব্য ও ধর্মমঙ্গল কাব্যে গাজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে গাজন বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন ভাবে পালন করা হয়। তবে ধূমধামের দিক দিয়ে রাঢ় বাংলা অনেকটাই এগিয়ে। বিশেষ করে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা ও মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার গাজন সকলকে হার মানিয়ে দেয়। এছাড়া দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ২৬-৩০ চৈত্র গাজন পালিত হয়ে থাকে। সাধারণতঃ নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা যোগদান করলেও, সুন্দরবনের মানুষের মধ্যে সবথেকে বেশী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এই উৎসব।
এই সময়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। গাজনের প্রথম দিন হয় ‘মঠ সন্ন্যাস’। একজন মুখ্য সন্ন্যাসী সকলকে সন্ন্যাস দেন। এই ‘সন্ন্যাস’ কথাটিকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘উত্তুরী নেওয়া’ও বলা হয়ে থাকে। পরের দিন হয় মঠ সন্ন্যাস। এদিন ভক্তরা মানত করে বাবার পুকুরে স্নান সেরে মন্দিরের চারিদিকে গন্ডি কাটেন ও বাবার মাথায় জল ঢালেন। মঠের সন্ন্যাসের পর ২৮ চৈত্র হয় ‘হাট সন্ন্যাস’ বা ‘ঝাঁপ’। শিবমন্দির থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে বাঁশের মাচা বাঁধা হয়। একে বলা হয় ‘হাঙা’। এই হাঙার উপর থেকে সন্ন্যাসীরা নীচে সাজানো সিঁদুর মাখানো লোহার অস্ত্রের ওপর ঝাঁপ দেন। এর পরের দিনে হয় নীলপুজো অর্থাৎ নীল ষষ্ঠী। লৌকিক বিশ্বাস মতে চৈত্র মাসে দেবী চন্ডীকার সঙ্গে শিব ঠাকুরের বিবাহ হয়েছিল। এই বিবাহ উৎসব উপলক্ষ্যেই নীল উৎসবের সূচনা। গাজনের শেষদিন অর্থাৎ ৩০ চৈত্র হয় চড়ক যাত্রা। শিবের প্রিয় বেল কাঠ দিয়ে তৈরি চড়ক কাঠ পুকুর থেকে তোলা হয়। এরপর চড়ক কাঠ মাটিতে পুঁথে মাথায় আলের সঙ্গে কাঠ গেঁথে দেওয়া হয়। কাঠের দুই দিকে সন্ন্যাসীদের গামছায় বেঁধে অথবা পিঠের চামড়ায় বঁড়শির মতো গেঁথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সন্ন্যাসীদের ঝুলন্ত অবস্থায় সেই চড়ক গাছটিকে ঘোরানো হয়। তবে ১৮৬৫ সালে লর্ড বিডন সাহেব চড়কে বাণফোঁড়া অর্থাৎ পিঠে বঁড়শি গাঁথা নিষিদ্ধ করে দেন।
কালের নিয়মে আজ সব কিছুই পরিবর্তনশীল। সেই নিয়ম মেনেই গাজনেরও বিবর্তন ঘটে চলেছে। বাংলার সনাতনী এই সংস্কৃতিকে এখন প্রায় ভুলতেই বসেছি আমরা। তারই মধ্যে কাটোয়া-বর্ধমান জেলার বেশ কিছু গ্রামে এখনও ধূমধামের সঙ্গেই পালিত হয় চড়ক এবং গাজন। তবে এ বছর করোনার দাপটে এই উৎসবের ভিড় কমেছে। বেশ কিছু জায়গায় বন্ধও হয়ে গেছে চড়ক উৎসব। তবু নতুন বছরকে আপন করে নিয়ে আগামীর ওপরই ভরসা রাখছেন মানুষ। হয়তো আবার নতুন রূপে ফিরে আসবে পল্লী সমাজের এই প্রাচীন লোক-সংস্কৃতি।
কভার চিত্র – সঞ্জয় ঘোষ
অন্যান্য চিত্র ঋণ – শুভজিৎ
Discussion about this post