লেদার, কথাটা শুনলেই মনের মধ্যে সবার প্রথমেই আসে, ব্যাগ। লেদারের ব্যাগের আলাদা সৌন্দর্য। এছাড়াও আছে জ্যাকেট, প্যান্ট,বেল্ট,জুতো সবই। তবে এইসব কিছুর নেপথ্যেই যে আছে বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া, তা কি আমরা ভেবে দেখি? দিন দিন এসবের চাহিদা বেড়েই চলেছে। আর এই চাহিদা মেটাতেই আমরা হত্যা করি ঘোড়া, গন্ডার, কুমির, সাপ এই ধরনের বন্য প্রাণীদের। তবে চামড়ার পণ্য উৎপন্ন করার জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয় গরুর চামড়া। আর যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, তারা পরিবেশের সাথে সাথে শ্রমিকদের শরীরেরও ক্ষতি করে দেদার।
কথায় আছে কি না, সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকে। পশুদের ক্ষতি না করেও লেদার পাওয়া সম্ভব। এই ধরনের লেদারকে বলে ভেগান বা কৃত্রিম লেদার। এটি তৈরি করতে কোনো প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করা হয় না। তবে তেমন কোনো পার্থক্য নেই প্রাকৃতিক চামড়ার সাথে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভেগান লেদার তৈরি করা যায়। তার মধ্যে সবথেকে বেশি চমকপ্রদ হলো নষ্ট আম থেকে ভেগান লেদার তৈরি। সর্বপ্রথম ফ্রুটলেদার নামক এক ডাচ কোম্পানি আম থেকে ভেগান চামড়া উৎপাদন শুরু করে।
ফ্রুটলেদারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হুগো ডি বুন। আর এই সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা কোয়েন মেরকার্ক। তারা দু’জনেই ২০১৫ সালে এই ভেগান লেদারের প্রথম ধারণা নিয়ে আসেন। তাদের উদ্দেশ্য- কিভাবে পরিবেশকে বাঁচিয়েও লেদার তৈরি করা সম্ভব। মেরকার্ক চান চামড়া শিল্পকে আরও পরিবেশবান্ধব করে তোলা। আর খাবার অপচয় বন্ধ করা। এবার আসি ঠিক কোন উপায়ে তৈরি করা হয় কৃত্রিম চামড়া! প্রথমে সংস্থা আমের পরিবর্তে তরমুজ ব্যবহার করতে চেয়েছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো তরমুজের ভিতরে ফাইবার খুব কম, নেই বললেই চলে। আছে মূলতঃ জল। এছাড়াও আছে আরও একটা কারণ। সংস্থা জানতে পেরেছিলো যে ইউরোপের অর্ধেকেরও বেশি আম নেদারল্যান্ডে আমদানি হয়। নেদারল্যান্ডে আমের প্রায় ১২% নষ্ট হয়। এই ভেগান লেদার তৈরি করার জন্য প্রথমেই আমদানিকারকের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫০০ আম সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে আমগুলোকে পরিণত করা হয় মন্ডে।
এরপরের ধাপ হলো একটি টিউবের সাহায্যে পাল্পের মিশ্রণটি একটি বড় ভ্যাটে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে এর মধ্যে কিছু অ্যাডিটিভ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই জিনিসটি আমের পাল্পকে চামড়ার মতো উপাদানে রূপান্তরিত করে। এই উপাদানের পরিমাপ একদম ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য এক ধরনের মিটার ব্যবহার করা হয়। যখন দেখা যায় পরিমাপ ঠিক আছে, তখন মিশ্রণকে ধাতব বেকিং ট্রের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হয়। মিশ্রণটিকে মসৃণ করে দেওয়া হয় যাতে ট্রের পুরোটা জুড়ে ছড়িয়ে যায়।
এরপর ট্রে-গুলোকে এক গোটা রাত ডিহাইড্রেটরের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। এখানেই খুব একটা মজার ব্যাপার দেখা যায়। শুকিয়ে যাওয়ার আগে সবসময় মিশ্রণটি হালকা ক্রিম রঙের থাকে। কিন্তু ঘোল বদল হয়ে যায় শুকানোর পর। এইসব কিছুর পর শীটগুলো লেদার-ফিনিশিং এ চলে যায়। সেখানে এদের উপর একটি করে প্রতিরক্ষামূলক গ্লেজ দেওয়া হয়। তা দিয়ে এক ধরনের প্রলেপ দেওয়া হয়। তার কিছু বাদে শীটগুলোকে একটি পরিবাহকের মাধ্যমে ওভেনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার ভিতর প্রায় ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে প্রলেপটিকে শুকোতে দেওয়া হয়। ব্যাস! এরপর শীটগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ঠান্ডা করা হয় এবং অবশ্যই শুকিয়ে ফেলা হয়। তবে শীটগুলোকে আরও বেশি টেকসই করতে বারংবার এই প্রক্রিয়াটি করা হয়। তারপর একটি মেশিনের সাহায্যে একাধিক প্রলেপের স্তরগুলিকে একসাথে করার জন্য তাপ এবং চাপ দুটোই প্রয়োগ করা হয়।
এবার আসা যাক সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় জায়গায়। ভেগান লেদার উৎপন্ন করার চূড়ান্ত ধাপ হলো এর নকশা। এই নকশা কাটার জন্য জন্যই একটি এমবসিং মেশিন ব্যবহার করা হয়। এই মেশিন ভেগান লেদারকে ঠিক পশুর চামড়ার মতো দেখতে তৈরি করে। এই মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় ফ্রুটলেদার তৈরি। এইসব কিছুর পর সারা বিশ্বের ডিজাইনারদের কাছে এই লেদার বিক্রি করা হয়। পশুদের জীবন কেড়ে তা থেকে চামড়া তৈরির চেয়ে এই ভেগান লেদার ঢের ভালো নয় কি?
Discussion about this post