এক ছাপোষা মৎসজীবী। ভারত মহাসাগরের বুকেই কেটে গেছে তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়। তিনি সমুদ্র চষতে বেড়িয়ে মাঝেমধ্যেই লক্ষ্য করতেন জলের মধ্যে ভেসে থাকা প্লাস্টিকের প্যাকেট, কাগজের কাপ। যে সমুদ্রকে তিনি তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি বানিয়েছিলেন তার এহেন বেহাল অবস্থা বুকে বাজত তার। অবশেষে একদিন ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যায় তাঁর। সেদিন মাছ ধরতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন, আবর্জনা জমতে জমতে স্তূপ হয়ে গেছে। বুঝতে পেরেছিলেন সমুদ্র থেকে আবর্জনা সরাতে না পারলে এই আবর্জনাই একদিন গিলে খাবে সমুদ্রকে। সেদিন তিনি সম্পূর্ণ একা হাতে পরিষ্কার করলেন যথা সম্ভব আবর্জনা।সালটা ছিল ১৯৯৯। সেদিনকার সেই ছোট্ট উদ্যোগ এরপর ধীরে ধীরে বদলে যায় তাঁর প্রাত্যহিক রুটিনে। প্রতিদিনই মাছ ধরা শিকেয় তুলে তিনি সমুদ্রে গিয়ে পরিষ্কার করতেন জজ্ঞালের পাহাড়। তিনি হলেন বালি দ্বীপের বাসিন্দা ওয়ায়ান নিও।
আমাদের চারপাশে যখনই কিছু মানুষ ব্যক্তি স্বার্থের চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটেন তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর কপালে জোটে ‘পাগলের তকমা’। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নিওর এই ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ‘ দেখে সেদিন হেসেছিলেন গ্রামশুদ্ধু লোক, বিরক্ত হয়েছিলেন পরিবারের মানুষরাও। কিন্তু তাতেও দমে যাননি শীর্ণকায় এই বৃদ্ধ। বাইশ বছরের ধরে এভাবেই তিনি প্রাণপণে সরিয়ে গেছেন পৃথিবীর জঞ্জাল।
নিওর গল্পটা হয়তো এভাবেই সবার চোখের আড়ালে শেষ হয়ে যেত যদি না তাঁর সাথে দেখা হত আমেরিকান পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ডানা ফ্র্যাংকের। নিওর এই অসম লড়াই মুগ্ধ করেছিল ফ্র্যাংককে। তাঁকে নিয়েই তিনি বানিয়ে ফেলেন জীবনের প্রথম তথ্যচিত্র ‘ভয়েস অ্যাবাভ ওয়াটার। ২০২১ সালে মুক্তি পাওয়া এই তথ্যচিত্রটির হাত ধরেই নিওর গল্প আজ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতিটা কোনায়। সান লুই অবিসপো চলচিত্র উৎসবে সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি একাধিক আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে সমাদর কুড়িয়েছে ‘ভয়েস অ্যাবাভ ওয়াটার। জীবনের শেষ লগ্নে এসে নিও তাঁর কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি খুঁজে পেয়েছেন ডানার মতো কমরেডদের।
প্রতিবারের মতো এবারেও পরিবেশ দিবসে জ্ঞানগর্ভ পোস্টে আমরা ভরিয়ে তুলেছি ফেসবুক। কোট করেছি জগদীশচন্দ্রের লাইন, গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। টেলিভিশন জুড়ে পরিবেশ নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু ঝড়ালেন পরিবেশ ধ্বসের কাণ্ডারি বৃহৎ পুঁজিপতিরাও। এই প্রতিবাদের মেয়াদ শধুমাত্র আজকের দিনটুকুই। আর এই দেখনদারি থেকে লক্ষ্য যোজন দূরে প্রতিদিন নিরলসভাবে জঞ্জাল সাফ করে যাবেন বুড়ো জেলে ওয়ানান নিমো, গঙ্গা দূষণ আটকাতে প্রাণ বিকিয়ে দেবেন জিডি আগরওয়াল আর গাছ আগলে লড়াই জারি রাখবেন মূলনিবাসী রমণীরা। সমাজ আর রাজনীতির বিষাক্ত চক্রবূহ্যের মুখে দাঁড়িয়েও ছেদ পড়েনি এই লড়াইয়ে। দীর্ঘ পরিবেশ আন্দোলনে আমাদের প্রাপ্তি বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা নিঃসন্দেহে শোষিত শ্রেণীর এই লড়াইটুকুই।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – The Vale Magazine
Discussion about this post