সময়টা ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি। কলকাতা গোয়েন্দা দপ্তরের অফিসে সেদিন দুপুরবেলা তুলকালাম কাণ্ড! স্পেশাল অফিসার গোল্ডি সাহেবের গালে সপাটে চড় কষিয়েছেন বছর ত্রিশের এক বন্দিনী। দ্বিতীয় চড়টি মারার আগেই অবশ্য তাঁর হাত চেপে ধরেছেন অফিসের অন্য কর্মীরা। সেই অবস্থাতেও ক্রুদ্ধা বাঘিনীর মত গর্জাচ্ছেন তিনি। “এত বড় স্পর্ধা তোমাদের? আমাদের দেশের মানুষ পরাধীন বলে কি কোন মান-সম্মান নেই? চিঠিটা যদি ছিঁড়েই ফেলবে তবে লিখতে বলেছিলে কেন?” তেজ দেখে তো সবাই একেবারে থ! জেলে তাঁর ওপর লাগাতার পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে অনশন করে আছেন তা প্রায় একুশ দিন হল। অথচ কোনও দুর্বলতা নেই, মনোবলও অটুট। এমনই দৃঢ়চেতা এই বাঙালি ঘরের বিধবা। ননীবালা দেবী, বাংলার প্রথম মহিলা স্টেট প্রিজনার।
১৯১৬ সালের প্রথম দিকে অনেক খানা তল্লাশির পর রিষড়ার এই মহিলা বিপ্লবীকে পেশোয়ার থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে রাখা হয়েছিল কাশীর এক পুরনো জেলে। তাঁর ওপরে নানাভাবে অত্যাচার করেও বিপ্লবীদের বিষয়ে একটি কথাও বের করতে পারেননি কাশীর দুঁদে জেল সুপার জিতেন ব্যানার্জী। এমনকি জমাদারনীদের দিয়ে শরীরের গোপনাঙ্গে লঙ্কাবাটাও লাগানো হয়েছিল। কিন্তু টুঁ শব্দটিও বের করা যায়নি তাঁর মুখ থেকে। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁকে স্যাঁতসেঁতে আলো-বাতাস হীন এক আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে একা আটকে রাখা হয় দিনের পর দিন। তবুও তাঁর মুখ থেকে একটি কথাও বের করা যায়নি। এর সঙ্গেই চালিয়ে গেলেন অনশন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।
জেল থেকে রোজকারের মত সেদিনও তাঁকে জেরা করার জন্য গোয়েন্দা অফিসে আনা হয়েছিল। সাহেব তাঁকে বারবার অনশন তুলে নেবার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি বলে বসলেন,“অনশন তুলে নিতে পারি একটি শর্তে। আমাকে বাগবাজারে শ্রীসারদা মা’র কাছে রেখে আসতে হবে।” শুনে সাহেব বললেন তা চিঠিতে লিখে দিতে। তিনি চিঠি লিখলেন। এরপর মুচকি হেসে সাহেব চিঠিটি নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে। আর যায় কোথায়? তখনই ওঁর গালে পড়ল সপাটে এক চড়! এক সাধারণ কালো চামড়ার মেয়ের কি স্পর্ধা!
১৮১৮ সালে তিন নম্বর রেগুলেশনের ধারা প্রয়োগ হল তাঁর বিরুদ্ধে, রাজবন্দি হিসাবে প্রেসিডেন্সি জেলে চালান হলেন তিনি। বাংলার প্রথম রাজবন্দি তিনি। হাওড়া জেলার বালির এক সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। সেই সময়ের সামাজিক রীতি মেনে মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯০৪ সালে স্বামী মারা গেলেন। বয়স তখন মাত্র ১৬। সেকালের আর পাঁচটা বাঙালি বিধবার মতো বাকি জীবনটা পুজো বা উপবাসে কাটিয়ে দেবার পাত্রী তিনি ছিলেন না। সামান্য লেখাপড়াও জানতেন, তাই ঠাঁই হলোনা শ্বশুর বাড়িতে। বাপের বাড়ীতে ভাইপো অমরেন্দ্র চ্যাটার্জি ছিলেন নামকরা বিপ্লবী, চরমপন্থী যুগান্তর পার্টির নেতা। তিনিই তাঁকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। শুরু হল ননীবালার জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির একজন নির্ভরযোগ্য সক্রিয় সহযোগী। দেশকে ভালোবেসে বিপ্লবীদের হয়ে তিনি নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতেন। নিপুণ দক্ষতায় সে কাজ সম্পন্নও করতেন। অনেক কাছের মানুষও টের পেত না যে তিনি বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য। এক জায়গার নেতাদের নির্দেশ ও নানা দরকারী খবর অন্য জায়গায় বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিয়ে বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি। এমনকি সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র ও গোপনে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। সেসময় থাকতেন রিষড়ায় এক ভাড়াবাড়িতে। সেখানে অনেকদিন লুকিয়ে রেখেছিলেন ভাইপো অমরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে। ফেরারী অন্য বিপ্লবীদেরও আশ্রয় দিতেন সেই বাড়িতে। সারাদিন তকলিতে সুতো কেটে পৌঁছে দিতেন যারা পৈতে বানাতেন তাদের কাছে। বাল্যবিধবাদের সেটাই ছিল তখন একমাত্র জীবিকা। ঘুর্ণাক্ষরেও কেউ সন্দেহ করেনি তাঁকে।
ইতিমধ্যেই ১৯১৮ সালে ঘটে গেছে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভারত-জার্মান অস্ত্র ষড়যন্ত্রের ঘটনা। চারদিকে শুরু হয়েছে ব্যাপক ধরপাকড়। যুগান্তর দলের প্রধান বিপ্লবী বাঘা যতীন কাপ্তিপদায় পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা গেছেন। কলকাতাতে পুলিশি ধরপাকড়ের সময় অমরেন্দ্র চ্যাটার্জি পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে যান রামচন্দ্র মজুমদার। তাঁর হাতে একটি মাউজার পিস্তল এসেছিল কিন্তু তিনি সেটি কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন তা কেউ জানতো না। বিপ্লবীরা পড়লেন সমস্যায়, কীভাবে সেটার খোঁজ পাওয়া যাবে? জেলে ঢুকে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে পিস্তলের খোঁজ আনতে চললেন দুঃসাহসী সেই মহিলা। সেদিনের সমাজে যা কেউ কল্পনাও করতে পারত না তাই করলেন তিনি। হিন্দু ঘরের বিধবা মহিলা শাঁখা সিঁদুর পড়ে একগলা ঘোমটা দিয়ে রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে স্বামীর সঙ্গে দেখা চললেন জেলে। সবার চোখে ধুলো দিয়ে পিস্তলের সন্ধান জেনে তা জানিয়ে দিলেন বিপ্লবীদের। এই খবর যথাসময়ে উঠলো পুলিশের কানে, গোয়েন্দারা উঠে পড়ে লাগল তার সন্ধানে। দু-চারবার আস্তানা বদলে একদম উধাও হয়ে গেলেন তিনি। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে তাঁর খোঁজ মিলল পেশোয়ারে। গ্রেপ্তার হবার সময় তিনি কলেরায় আক্রান্ত ছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁকে তোলা হলো কাশীর জেলখানায়। অভিযোগ বেআইনি অস্ত্র রাখা, বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ১৯১৬ সালে ধরা পড়ার চার বছরের মাথায় ১৯১৯ সালে মুক্তি পেলেন। অসুস্থ ভগ্নস্বাস্থ্য মহিলার তখন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। এক পূর্বপরিচিতের অনুগ্রহে একটি কুঁড়ে ভাড়া পেলেন হুগলিতে। সুতো কেটে রান্নার কাজ করে কোনমতে আধপেটা খেয়ে তাঁর দিন কাটতে থাকে। সে সময় কেউ তাঁর খবর নেওয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করেনি। অবশেষে ১৯৬৭ সালে মৃত্যু এসে তাঁকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়। আজ আর কারও মনে নেই তাঁর আত্মত্যাগের কথা। বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবী।
তথ্য ঋণ – উমা ভট্টাচার্য্য, ‘সেই মেয়েরা’
Discussion about this post