উর্দু সাহিত্যিক ইসমত চুগতাইকে তাঁর বোরখা পরা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, “আমাকে বোরখা পরে পড়াশোনা করা ও লেখার সুযোগ দেওয়া হলে তাইই করব।” ঠিক এমনটাই খাটে সাইদা খানমের ক্ষেত্রেও। সাইদা বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আলোকচিত্রশিল্পী। অর্থাৎ প্রথম মহিলা ফটোগ্রাফার। চল্লিশের দশকের বাংলাদেশে একা মহিলার কাজ করা তো দূরের কথা, বাইরে বেরনোতেও লাগত অনুমতি। সেই সময়েই সাইদা ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পরেছিলেন। বাবার বিভিন্ন শর্ত মানতে হলেও তিনি তাঁর ভালবাসার কাজটি করে গিয়েছিলেন অক্লান্তভাবে। আজ সেই সাহসী শিল্পীর মৃত্যুর তিন বছর পূরণ হতে চলেছে।
১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন সাইদা খানম। ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই তাঁর ঝোঁক ছিল ছবি তোলার প্রতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য এবং লাইব্রেরি সায়েন্সে মাস্টার্স করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। তবে তাঁর ফটোগ্রাফার জীবনের শুরু ১৯৫৬ সালে ‘বেগম’ পত্রিকার আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে। পরে তাঁর ছবি ‘অবজারভার’, ‘মর্নিং নিউজ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’ ইত্যাদি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন তিনি। ভারত, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, পাকিস্তান, সাইপ্রাস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়।
তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে রাইফেল হাতে প্রশিক্ষণরত নারীযোদ্ধাদের ছবি। সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যামেরা হাতে মহিলাকে দেখে সকলে বেশ অবাক হয়েছিলেন নিশ্চয়ই। ১৯৬২ সালে ‘চিত্রালী’ পত্রিকার জন্য সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলেছিলেন তিনি। এছাড়া সাইদা, কাজী নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা গান্ধী, মুজিবুর রহমান, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রানী এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত সব মানুষদের ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’ এবং ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’- এই তিনটি ফিল্মের শুটিংয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলেছিলেন।
নারী হিসেবে সাইদা ভেঙ্গেছেন সামাজিক প্রথা। তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে মানুষের কথা। কাজের প্রয়োজনে বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে ক্যামেরা হাতে নেমেছেন গ্রাউন্ড জিরোতে। সারাজীবন ছবি তুলে গেছেন। আধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরার পরিবর্তে ভালোবেসেছেন ফিল্ম ক্যামেরাকে। ফোটোগ্রাফার হিসেবে পেয়েছেন স্বীকৃতিও। জার্মানিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন পুরস্কার, জাপানে ইউনেসকো অ্যাওয়ার্ড, অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার, বেগম পত্রিকার ৫০ বছর পূর্তি পুরস্কার, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সম্মানসূচক ফেলো, একুশে পদক সবই তাঁর ঝুলিতে। ছবি তোলার পাশাপাশি লেখালেখি ও পড়াশোনা করেছেন শেষ বয়স পর্যন্ত।
চিত্র ও তথ্য ঋণ – গেরিলা ৭১
Discussion about this post